যেসব কারণে জীবনে অন্তত একবার হলেও নিউ ইয়র্ক যাওয়া উচিত

2285
0

আধুনিক বিশ্বের সমৃদ্ধতম মেট্রোপলিটন শহরগুলোর একটি নিউ ইয়র্ক। শিল্প, ফ্যাশন, খাবার কিংবা নাট্যকলা- সবদিক থেকেই নিউ ইয়র্কের আছে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। গতিশীলতা আর জীবনযাত্রার মানের দিক থেকেও বাকি গোটা বিশ্বের চেয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে স্বপ্নের এই শহর। এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা যারা, তারা নিঃসন্দেহে দারুণ সৌভাগ্যের অধিকারী।

পর্যটকদের জন্য এই শহরের আবেদন কোনো অংশে কম নয়। আপনি যদি ভ্রমণপিয়াসু হয়ে থাকেন, বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সকল জায়গা ঘুরে দেখতে চান, তাহলে নিউ ইয়র্ককে আপনার বাকেট লিস্টে রাখতেই হবে।

অনেকগুলো কারণ আপনার সামনে হাজির করা সম্ভব, যেগুলোর জন্য জীবনে অন্তত একবার হলেও নিউ ইয়র্কে আপনার পা রাখা উচিত

পাঁচটি প্রশাসনিক অংশ

অনেকে নিউ ইয়র্ক বলতে কেবল ম্যানহাটনকেই বুঝে থাকেন। অথচ নিউ ইয়র্কের মোট পাঁচটি প্রশাসনিক অংশ আছে। ম্যানহাটন ছাড়াও রয়েছে ব্রুকলিন, কুইন্স, দ্য ব্রঙ্কস এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ড। নিজ নিজ জায়গা থেকে এরা সকলেই অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ব্রঙ্কসে আছে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানা, কুইন্সে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক জাতিগোষ্ঠীর রেস্তোরাঁ, ব্রুকলিনের উইলিয়ামসবার্গ, গ্রিন পয়েন্ট ও রেড হুকে অসাধারণ সব বাড়িঘর, এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে ফেরি ছাড়াও আছে স্নাগ হার্বারের জাদুঘর।

নিউ ইয়র্ক মানে কেবল ম্যানহাটন নয়; Image Source: Bo Bridges Photography

সেরা সেরা জাদুঘর আর আর্ট গ্যালারি

শিল্পের দিক থেকে নিউ ইয়র্ক যেন এক কথায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, গিগেনহাইমসহ অন্যান্য আরো অনেক জাদুঘরের উপস্থিতি এই শহরকে পরিণত করেছে শিল্পের এক তীর্থভূমিতে। লোয়ার ইস্ট সাইড, চেলসির মতো আর্ট গ্যালারিগুলোতে নবীন প্রতিভাদের সুযোগ করে দেয়া হয় আত্মপ্রকাশের।

অগণিত বৈচিত্র্যময় প্রাণীর দেখা মিলবে আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে। আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত জ্যাজম্যানকে জানা যাবে লুইস আর্মস্ট্রং হাউজ মিউজিয়ামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন নিদর্শন গচ্ছিত আছে ইন্ট্রাপিড সি, এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামে।

শিল্পের সমঝদারদের জন্য নিউ ইয়র্ক যেন তীর্থভূমি; Image Source: Alamy Stock

আকাশচুম্বী ভবন

ম্যানহাটন স্ট্রিট ধরে হেঁটে যাওয়ার মতো অসাধারণ অনুভূতি খুব কমই পাওয়া যায়। কেননা এই সড়কজুড়ে আকাশচুম্বী সব ভবনের সম্ভার। ১৯৩০-এর দশকের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, ক্রাইসলার বিল্ডিং যেমন আছে, তেমনই আছে ২০১৩ সালে কাজ শেষ হওয়া ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারও। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের উপর থেকে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা দর্শকের নিঃশ্বাস কয়েক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করে দিতে যথেষ্ট।

এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং; Image Source: Time Out

ভোজন রসিকদের স্বর্গ

নিউ ইয়র্ককে বলা হয়ে থাকে ভোজন রসিকদের স্বর্গ। এই শহরের রেস্তোরা ২৩ হাজারের মতো। পাওয়া যায় দেশ বিদেশের শত শত কুইজিন। বাবুর্চিরা সবসময়ই নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করে চলেছেন। লোভনীয় এসব খাবারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও যেন কষ্টকর মনে হয় না।

ভোজন রসিকদের জন্য নিউ ইয়র্ক যেন স্বর্গভূমি; Image Source: Alamy Stock

গানের আসর

যারা রেকর্ডেড গানের চেয়ে লাইভ গানের প্রতি বেশি অনুরাগী, তাদের মনোবাসনা পূর্ণ করতে নিউ ইয়র্কে সপ্তাহের সাতদিনই বসে শীর্ষস্থানীয় শিল্পী ও ব্যান্ডগুলোর লাইভ গানের আসর। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন কিংবা ব্রুকলিনের বারক্লেস সেন্টার তো আছেই, এছাড়া রেডিও সিটি মিউজিক হক, বেকন থিয়েটার, আরভিং প্লাজা, হ্যামারস্টেইন বলরুম, ওয়েবস্টার হল, উইলিয়ামসবার্গের ব্রুকলিন স্টিল কিংবা ফ্ল্যাটবাশের কিংস থিয়েটারেও প্রায়ই জমে গানের জম্পেশ সব আয়োজন।

প্রায় প্রতি রাতেই বসে লাইভ গানের আসর; Image Source: Rolling Stone

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

যদি ছবি তুলতে ভালোবাসেন, তাহলে সেন্ট্রাল পার্কের মতো দারুণ জায়গা খুব কমই খুঁজে পাবেন। ম্যানহাটনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত এই পার্কে আছে জন লেননের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ স্ট্রবেরি ফিল্ডস, আছে লুই ক্যারলের অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য, আর পার্কের প্রাণকেন্দ্রে আছে বেথেসডা ফাউন্টেন অ্যান্ড টেরেসও। ১৮৫৮ সালে চালু হওয়া এই পার্কের নকশা তৈরি করেছিলেন ফ্রেডেরিক ল ওমস্টিড এবং কালভার্ট ভো। তারা ১৮৬৭ সালে চালু হওয়া ব্রুকলিনে প্রসপেক্ট পার্কেরও নকশা করেছিলেন। দুটি পার্কেই আছে চিড়িয়াখানা, হ্রদ, হাজার হাজার সবুজ গাছ, আর অনন্য চারণভূমি। দর্শনার্থীরা চাইলে এই পার্ক দুটিতে এসে স্কেটিং করতে পারেন কিংবা হকিও খেলতে পারেন।

ছবি তোলার জন্য সেন্ট্রাল পার্কের চেয়ে ভালো জায়গা আর হতে পারে না; Image Source: Wikipedia

রাতের মনোরম নগরী

যাদের দিনের শুরুটাই হয় সূর্য অস্ত যাবার পর, তাদের জন্য নিউ ইয়র্কের মতো এত বিনোদনের স্থান পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এ শহরে আছে শত শত নাইটক্লাব ও ক্যাবারেট, যা বিনোদনপ্রেমীদের সবধরনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। যাদের ডান্স ফ্লোর পছন্দ, তাদের জন্য ম্যানহাটনে আছে চেলসি কিংবা মিটপ্যাকিং ডিসট্রিক্ট। ব্রুকলিনেও আছে শিমানস্কি কিংবা ব্ল্যাক ফ্যামিঙ্গোর মতো ক্লাব। কমেডিপ্রেমীদের জন্য আছে ক্যারোলিন্স, কমেডি সেলার ও ইউসিবি থিয়েটার।

রাতের টাইমস স্কয়ার; Image Source: Flickr

সেতুর শহর

নিউ ইয়র্কে মোট সেতুর সংখ্যা ৭৮৯। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী হলো ব্রুকলিন ব্রিজ। ১৮৮৩ সালে এটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ব্রুকলিন ও ম্যানহাটানের মাঝখানের নদীর উপর দিয়ে গিয়েছে এই সেতুটি। ৩০ মিনিট সময় ব্যয় করে যদি ব্রুকলিন থেকে ম্যানহাটনের দিকে ১.১৩ মাইল (১.৮২ কিলোমিটার) হেঁটে যান, ম্যানহাটনের আকাশের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে পাবেন, বিশেষত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়কার।

সেতুর শহর নিউ ইয়র্ক; Image Source: NYC Go

ভিন্ন ভিন্ন এলাকা

নিউ ইয়র্কের প্রতিটি এলাকাই যেন এক ও অদ্বিতীয়। ব্রুকলিনের পার্ক স্লোপে আছে দামি দামি ব্রাউনস্টোনের সারি। সোহো থেকে চায়নাটাউনের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময়ও নিজেকে আবিষ্কার করা যাবে ভিন্ন এক পৃথিবীতে। আর এটাই নিউ ইয়র্কের সৌন্দর্য।

চায়না টাউন; Image Source: Time Out

হাঁটার জন্য হাই লাইন

পার্কের ধারণাকে আমূল বদলে দিতে এসেছে হাই লাইন। ম্যানহাটনের রাস্তায় কংক্রিটের জঙ্গলের ফাঁকে যেন এক চিলতে মরূদ্যান। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তিন দফায় নির্মিত দুই কিলোমিটারের এই হাই লাইন। এটিকে কেউ বলে পার্ক, কেউ বা আবার স্বপ্ন দেখার স্থান। এই হাই লাইন ধরে খানিকক্ষণ হাঁটাও হতে পারে আপনার জন্য অনবদ্য এক অভিজ্ঞতা।

কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝে যেন একটুকরো মরূদ্যান; Image Source: Time Out

উপরের কারণগুলো যদি যথেষ্ট মনে না হয়, তাহলে আরো যোগ করতে পারেন এর বৈদ্যুতিক গতিময়তা আর এর বাসিন্দাদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রাও। চলতি শতকের সবচেয়ে আলোচিত টুইন টাওয়ার হামলার সাক্ষীও এই শহরই, যার ফলে এর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়। সব মিলিয়ে এই শহরের যেন আছে এক দুর্নিবার আকর্ষণ, যাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যদি সত্যিকারের ভ্রমণপিয়াসু হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই একটিবারের জন্য ঘুরেই আসুন নিউ ইয়র্ক।

লেখাঃ Jannatul Naym Pieal | সূত্রঃ রোয়ার বাংলা