শিল্প বিপ্লবের আদ্যপান্ত এবং বাংলাদেশে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা

700
0

শিল্প বিপ্লব নিয়ে আমরা কমবেশি সবাই জানি কিংবা শুনেছি। বর্তমানে ৪র্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে বেশ ভালোই শোরগোল চলছে। সারা বিশ্বে চলছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জয়গান। আর ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের মূল থিম এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে ঘিরেই। ৪র্থ শিল্প বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য কতটুকু ফলপ্রসূ? বাংলাদেশে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা কেমন? 

শিল্প বিপ্লব কি? 

৪র্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কে জানার আগে শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক শিল্প বিপ্লব আসলে কী? ১৮ শতকের শেষদিকে এসে শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে যা শিল্পবিপ্লব হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৮৩৭ সালে শিল্পবিপ্লব শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি সমাজতান্ত্রিক লেখক জেরোমি ব্ল্যাংকি। তবে ১৮৮১ সালে এটি বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করে। 

তৎকালীন সময়ে অক্সফোর্ডে দেওয়া এক বক্তৃতায় বিখ্যাত ইংরেজ গবেষক আর্নল্ড জে টয়েনবি এই শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় বরং রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বেশ ভালো প্রভাব ফেলে। একটি শিল্প বিপ্লবের মূল ধারণা থেকে আরেকটি শিল্প বিপ্লবের মূল ধারণা একদমই ভিন্ন ভিন্ন। 

প্রথম শিল্প বিপ্লবের মূল ধারণা ছিল পানি এবং বাষ্পশক্তিকে ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনকে মেকানাইজেশন অর্থাৎ যান্ত্রিকরণ করা। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের মূল ধারণা ছিল বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনকে বহুগুণে বৃদ্ধি করা। আর তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের মূল ধারণা ছিল ইলেক্ট্রনিকস এবং ইনফরমেশন সিস্টেমকে ব্যবহার করার মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয় করা।  

বর্তমান যুগ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। এটিকে ডিজিটাল রেভোলুশন বলা চলে। যা গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ঘটছে। এর মূল ধারণা হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া বজায় রাখা। 

শিল্প বিপ্লবের টাইমলাইন; Image Source: researchgate.com

৪র্থ শিল্প বিপ্লব

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের জীবনযাপন, কাজকর্ম এবং একে অপরের সাথে সম্পর্কিত পদ্ধতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করে। একে মানব উন্নয়নের একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে ধরা হচ্ছে, যা প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অসাধারণ প্রযুক্তি অগ্রগতির দ্বারা অর্জন করতে সক্ষম। 

এই অগ্রগতিগুলি ভৌত, ডিজিটাল এবং জৈবিক জগতকে এমনভাবে একীভূত করছে যা একইসাথে অনেক নতুন নতুন সুযোগ এনে দেওয়ার পাশাপাশি কিছু বিপত্তিও তৈরি করে। এই বিপ্লবের গতি, প্রশস্ততা এবং গভীরতা আমাদের পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে কীভাবে দেশগুলি বিকাশ লাভ করে, কীভাবে সংস্থাগুলি মূল্যবোধ তৈরি করে এবং এমনকি আমাদের মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার কারন।  

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব টেকনোলজি কেন্দ্রিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মানব-কেন্দ্রিক ভবিষ্যত তৈরি করার জন্য এবং একীভূত প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য নেতা, নীতি-নির্ধারক এবং সমস্ত আয় গোষ্ঠী এবং জাতির মানুষ সহ সবাইকে সাহায্য করার একটি সুযোগ তৈরি করেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে  প্রযুক্তির বাইরে যেয়েও অসংখ্য মানুষকে, তাদের পরিবার, সংস্থা এবং কমিউনিটিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলা।  

৪র্থ শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য এবং মূল বিষয়

৪র্থ শিল্প বিপ্লবের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-

  • ইন্টারকানেক্ট: মেশিন, ডিভাইস, সেন্সর এবং মানুষকে ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) বা ইন্টারনেট অফ পিপল (IoP) এর মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযোগ স্থাপন করা। 
  • ডেটা: সিস্টেম এবং কম্পিউটারের মধ্যে ইন্টারকানেকশন এবং ইন্টেলিজেন্স মেশিনের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে ডেটা বিশ্লেষণ করা। কোন মানুষের সাহায্য ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। 
  • ইন্ট্রিগ্রেশন: টেকনোলজিকে হিউমান কমিউনিটি এবং ইন্ডাস্ট্রির সাথে সমন্বয় করেছে। 
  • ইনোভেশন: বিভিন্ন টেকনোলজির ইন্ট্রিগ্রেশনের মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় আবিস্কার করা। যেমন: রোবটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বিগ ডেটা ইত্যাদি।  
  • ট্রান্সিশন: ফিজিক্যাল, ডিজিটাল এবং বায়োলজিকাল সিস্টেমের মধ্যকার যে বাউন্ডারি রয়েছে তা দূর করেছে।  

৪র্থ শিল্প বিপ্লবের মূল বিষয়গুলো হচ্ছে-

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই 

এআই বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এই বিপ্লবের সবকিছুর মূলে রয়েছে। এটি এমন একটি টেকনোলজি যা সমাজ, শ্রমবাজার এবং অর্থনীতির রূপান্তরকে প্রভাবিত করে।

ইন্টারনেট অফ থিংস

ইন্টারনেট অফ থিংস হচ্ছে ফিজিক্যাল এবং ডিজিটাল বিশ্বের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এটি ইতিমধ্যেই অনেক সেক্টরকে প্রভাবিত করেছে এবং দিন দিন ডিভাইসকে আরও বেশি স্মার্ট করে তুলছে। 

কোবট; Image Source: pexels.com

কোবট 

কোবট হল রোবট যা কোঅপারেটিভ এনভার্নমেন্টে মানুষের সাথে সহজে কমিউনিকেশন করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। তারা শুধুমাত্র প্রোডাকশনকে অপ্টিমাইজ করে না বরং মানুষকে একঘেয়ে বা বিপজ্জনক কাজ করা থেকেও বাঁচায়।

অগমেন্টেড রিয়েলিটি এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি

এআর এবং ভিআর বাস্তব জগত এবং ডিজিটাল বিশ্বের মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় । 

বিগ ডেটা

বিগ ডেটা ব্যবসাগুলিকে সহজে বিশাল ডেটা পরিচালনা এবং ব্যাখ্যা করতে সক্ষম করে। এটি ব্যবসাগুলিকে কার্যকরভাবে ব্যবসার কৌশল তৈরি করতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে।

থ্রিডি এবং ফোরডি প্রিন্টিং 

থ্রিডি এবং ফোরডি প্রিন্টিং ব্যবহার করে অনেক দ্রুত, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং সঠিক উপায়ে প্রোটোটাইপ এবং পণ্য তৈরি করা যেতে পারে। 

থ্রিডি প্রিন্টিং মেশিন; Image Source: istock.com

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জসমূহ 

কোথাও বেড়াতে যাওয়ার জন্য ক্যাব বুক করা থেকে শুরু করে বিমানের টিকিট কাটা, যেকোনো কিছুর পেমেন্ট করা এমনকি হোটেলের রুম বুকিং দেওয়া যায় শুধু একটি ক্লিকের মাধ্যমেই! টেকনোলজির ব্যবহার আমাদের জীবনযাপনকে যেমন আরামদায়ক করেছে ঠিক তেমনই করেছে সহজ। 

৪র্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন কার্যক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতায় দীর্ঘমেয়াদী লাভসহ সাপ্লাই সাইডেও মিরাকেল ঘটাবে। পরিবহন এবং যোগাযোগের খরচ কমে যাবে, লজিস্টিক এবং গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন আরও কার্যকর হয়ে উঠবে এবং বাণিজ্যের খরচ কমে যাবে, যার সবগুলোই নতুন বাজার খুলবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চালাবে। তবে সবকিছুরই সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধাও থাকে। 

প্রথমত, অর্থনীতিবিদ এরিক ব্রাইনজলফসন এবং অ্যান্ড্রু ম্যাকাফি যেমন উল্লেখ করেছেন, এই বিপ্লব অনেক বেশি বৈষম্য আনতে পারে, বিশেষ করে শ্রমবাজারকে ব্যাহত করতে পারে। সমগ্র অর্থনীতিতে শ্রমের জন্য অটোমেশন মানব শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করলে, রিটার্নস টু ক্যাপিটাল এবং রিটার্নস টু লেবারের মধ্যে একটি গ্যাপ সৃষ্টি হয় এবং শ্রমে এর মধ্যের ব্যবধানকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। অন্যদিকে, এটাও সম্ভব যে প্রযুক্তির দ্বারা শ্রমিকদের রিপ্লেস করা হলে সামগ্রিকভাবে নিরাপদ এবং ফলপ্রসূ চাকরিতে নেট বৃদ্ধি ঘটাবে। 

দ্বিতীয়ত, এতদিন আমরা মূলধনকে উৎপাদনের প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করতাম। কিন্তু ৪র্থ শিল্পবিপ্লব সেই ধারণাকে যেন একেবারেই বদলে দিয়েছে। মূলধনকে রিপ্লেস করেছে মেধা দিয়ে। মেধাকেই উৎপাদনের প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি চাকরির বাজারকে ক্রমবর্ধমানভাবে “নিম্ন-দক্ষতা/নিম্ন-বেতন” এবং “উচ্চ-দক্ষতা/উচ্চ-বেতন” বিভাগে বিভক্ত করবে, যার ফলে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। 

৪র্থ শিল্পবিপ্লবে পৃথিবীতে হবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। Image Source: weforum.org

উচ্চ আয়ের দেশগুলিতে বেশিরভাগ জনসংখ্যার জন্য আয় স্থবির বা এমনকি কমে যাওয়ার প্রধান কারনগুলির মধ্যে একটি হল প্রযুক্তি: উচ্চ দক্ষ কর্মীদের চাহিদা বেড়েছে যখন কম শিক্ষিত এবং কম দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীদের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে।

যার ফলাফল উচ্চ এবং নিম্ন প্রান্তে একটি শক্তিশালী চাহিদাসম্পন্ন চাকরির বাজার, কিন্তু মাঝখানে একটি গ্যাপ থেকেই যায়। আর এই গ্যাপ তৈরি করে সামাজিক বৈষম্য। আর এই সামাজিক বৈষম্যে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে ওতপ্রেতভাবে জড়িত আছে। 

৪র্থ শিল্পবিপ্লবের কারনে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার রাতারাতিভাবে বেড়েছে। এখন খুব সহজেই এবং কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তথ্য আদান প্রদান করা যায়। এটি যেমন সুফল বয়ে এনেছে তেমনি এনেছে অপরিসীম দুর্ভোগ। কারন এখন খুব সহজেই যেকোনো গুজব রটানো যায়। মানুষ সময় নিয়ে কোনো তথ্যও যাচাই বাছাই করে না। ফলে প্রোপাগান্ডা হতেও সময় নেয় না। এছাড়াও ভুল তথ্য আরও অনেক অসুবিধা সৃষ্টি করে। তৈরি করে মারাত্মক বিপদ। 

ব্যবসা বানিজ্যে প্রভাব

৪র্থ শিল্প বিপ্লব বোধহয় ব্যবসা বানিজ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে বলে ধারণা করা হয়। 

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চারটি প্রধান প্রভাব রয়েছে ব্যবসার ওপর—

১. ভোক্তার প্রত্যাশার উপর
২. প্রোডাক্ট কতটুকু ইম্প্রুভমেন্ট হয়েছে তার উপর
৩. কোলাবরেটিভ উদ্ভাবনের উপর
৪. অরগানাইজেশনের ফরমেশনের উপর

ভোক্তা হোক বা ব্যবসা, গ্রাহকরা ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, যা গ্রাহকদের কীভাবে সার্ভিস দেওয়া হয় তা উন্নত করা। ফিজিক্যাল প্রোডাক্ট এবং সার্ভিসগুলোতে এখন ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ভ্যালু অ্যাড করা যেতে পারে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। Image Source: pinterest.com

ফলে নতুন প্রযুক্তি আরও টেকসই  করে তোলে, যখন ডেটা এবং অ্যানালাইটিক্স কীভাবে রূপান্তরিত করে৷ কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স, ডেটা-ভিত্তিক সার্ভিস এবং অ্যানালাইটিক্সের মাধ্যমে অ্যাসেট পারফরম্যান্স চেক করার জন্য সহযোগিতার প্রয়োজন।  

সামগ্রিকভাবে, সাধারণ ডিজিটাইজেশন (তৃতীয় শিল্প বিপ্লব) থেকে প্রযুক্তির সংমিশ্রণ (চতুর্থ শিল্প বিপ্লব) এর উপর ভিত্তি করে উদ্ভাবনে অদম্য স্থানান্তর কোম্পানিগুলিকে তাদের ব্যবসা করার পদ্ধতিটি পুনরায় পরীক্ষা করতে বাধ্য করছে। তবে নিরলসভাবে ক্রমাগত উদ্ভাবন করে যেতে হবে। 

সরকারের উপর প্রভাব

পূর্বে সাধারণ জনগণের মতামত সরকারের পক্ষে জানাটা বেশ কঠিন ছিল। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে জনগণ সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে খুব সহজেই নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারে। ফলে সরকার ও জনগণের মাঝে একটি সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে খুব সহজেই। এছাড়াও প্রতিবাদ করার মাধ্যমে সরকারকে চাপের মুখেও ফেলতে পারে যেকোনো মুহূর্তেই! তবে সরকারের জন্যেও সাধারণ জনগণকে নজরদারি করা পূর্বের তুলনায় বেশ সহজতর হয়ে গিয়েছে। 

মানুষের উপর প্রভাব

৪র্থ শিল্প বিপ্লব মানুষের মন মানসিকতা এবং কাজ কর্মের উপর রাতারাতি প্রভাব ফেলেছে। এটি আমাদের আইডেন্টিটি এবং এর সাথে সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ের উপর প্রভাব ফেলছে। আমাদের যেকোনো বিষয়কে গোপন রাখার পরিমাণ, আমাদের যেকোনো তথ্যের উপর মালিকানার ধারণা, আমাদের কনজাম্পশন প্যাটার্ন, আমরা কাজ এবং অবসরের জন্য যে সময় ব্যয় করি এবং কীভাবে আমরা আমাদের ক্যারিয়ার বিল্ড আপ করি, আমাদের দক্ষতা গড়ে তুলি, কারো সাথে দেখা করি, সম্পর্ক গড়ে তুলি এবং তা মেইন্টেইন করি এসকল বিষয়ের উপরেও প্রভাব ফেলছে।

তবে ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে উদ্ভাভাবিত নতুন প্রযুক্তির সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিক হচ্ছে তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিতকরণ। নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াও অনেক কাজকর্ম করা সহজ হলেও বিভিন্ন কারনে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করতে হয় এবং সেসকল তথ্য ট্র্যাকিং করা হয়। এভাবে আমারাই আমাদের তথ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি বলে ধারণা করা হচ্ছে।  

চতুর্থ শিল্পবিল্পবে বাংলাদেশের অবস্থান। Image Source: tbs.net

বাংলাদেশের অবস্থান এবং অবস্থা 

বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনও অনেকটা পিছিয়ে আছে। যেখানে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ যেমন- দুবাই; পেপারলেস সিস্টেম ব্যবহার করা শুরু করেছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে এখনও সেরকম উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

অটোমেশন প্রযুক্তি যেমন AI, 3D প্রিন্টিং, AR বা VR – এর কোনটিই দেশের পোশাক কারখানায় ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। যা বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য খুবই প্রয়োজন। 

কিন্তু বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে অটোমেশন চালু করা হলে অনেক গার্মেন্টস কর্মীদের চাকরি হারাবে যা 4IR-এর ক্ষেত্রে একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। a2i-এর একটি সমীক্ষা বলছে যে ৬০% গার্মেন্টস শ্রমিক ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের চাকরি হারাতে পারে।

এই সমস্যার প্রতিকারের জন্য, অদক্ষ শ্রমশক্তির প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করা এবং অটোমেশন চালু করার সময় তাদের আধা-দক্ষ বা সম্পূর্ণ দক্ষ শ্রমশক্তিতে পরিণত করা প্রয়োজন। এটি কেবল প্রোডাক্টিভিটি বাড়াবে না বরং আরও স্কিল্ড লেবার পাওয়া যাবে।  

পোশাক নির্বাচনে অগমেন্ট রিয়ালিটি ব্যবহার ; Image Source: istock.com

আরেকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মোটেও প্রস্তুত নয় তা হল শিক্ষা খাত। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এর ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৭৫০০-৮০০০ নতুন প্রযুক্তিগত চাকরির সুযোগ তৈরি হয়।

যদিও প্রায় ২০ হাজার কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল স্নাতক বার্ষিক চাকরির বাজারে প্রবেশ করে, তাদের মধ্যে ৮০% এরও বেশি নিয়োগকর্তাদের দ্বারা নির্ধারিত নিয়োগের মান পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, গবেষণায় বলা হয়েছে।

টেস্টিং, বিজনেস অ্যানালাইটিক্স এবং প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের মতো মধ্য-স্তরের দক্ষতার জন্য দেশীয় প্রতিভা খুঁজে না পাওয়ায় বাংলাদেশের উৎপাদন শিল্প প্রতিবেশী দেশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ মজুরিতে লোক নিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে।

স্কুল ও কলেজের বর্তমান পাঠ্যক্রম 4IR-এর জন্য প্রয়োজনীয় সফট স্কিল শেখায় না বা 4IR প্রযুক্তির অনেকগুলিই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কম্পিউটার বিজ্ঞান কোর্সে শেখানো হয়। নতুন বিপ্লবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।

তবে ব্লকচেইন ভিত্তিক সাপ্লাই চেইন ফাইন্যান্সের সাম্প্রতিক সূচনা সহ ডিজিটাল ফ্রন্টে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করে ২০ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল সিঙ্গাপুরে রপ্তানি করা হয়েছিল এবং এলসি-প্রসেসিং সময় ৫-১০ দিন থেকে কমিয়ে মাত্র ২৪ ঘন্টা করা হয়েছিল।

গত চার বছরে, জেলা পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। তবুও, 4IR-এর সম্পূর্ণ সুবিধা নিশ্চিত করতে, আমাদের ইউনিয়ন/গ্রাম স্তরে উচ্চ-গতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন। ইতিবাচক বিষয় হল সরকার একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং মনে হচ্ছে আগামী কয়েক বছরে গ্রামীণ এলাকায় ব্রডব্যান্ড সংযোগের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। 

প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষের উৎকর্ষ সাধনই চতুর্থ শিল্পবিল্পব। Image Source: pinterest.com

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শক্তিশালী ডেটা সেন্টার থাকা যা সরকার এবং বিজনেস সেক্টরকে সহায়তা করতে পারে। বাংলাদেশে ডেটা সেন্টার তৈরি করতে অ্যামাজন, মাইক্রোসফ্ট এবং গুগলের মতো ক্লাউড স্টোরেজে বিশ্ব নেতাদের যুক্ত করা প্রয়োজন। সরকার ইতিমধ্যে টায়ার ফোর এবং টায়ার থ্রি ডেটা সেন্টার স্থাপন করেছে এবং তাদের ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

4IR এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল 5G সংযোগ। 4IR 5G প্ল্যাটফর্মে চালু হয়েছে। 5G বাস্তবায়ন ব্যবসাগুলিকে চলতে চলতে উচ্চ-গতির ডেটা স্থানান্তর অ্যাক্সেস করতে সক্ষম করবে। সুতরাং, সাশ্রয়ী মূল্যে 5G অফার করা নিশ্চিত করা 4IR-এর অন্যতম প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত হয়ে উঠতে পারে।

এখনই সময় বাংলাদেশ নীতি তৈরি করেছে এবং 4IR-এর দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। এবং এটি কেবল স্মার্ট মেশিন কেনা এবং কারখানার ভিতরে স্থাপন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। সম্ভাব্য বেকার সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সে বিষয়ে সরকারকে নীতিমালা তৈরি করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, অটোমেশন নীতি যা কারখানার মালিকদেরকে একবারে অটোমেশন দিয়ে এমপ্লয়ি রিপ্লেসমেন্ট করতে বাধা দেয়। 

বিশ্বের সর্বত্র অটোমেশন এবং কম্পিউটিংয়ের দ্রুত বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বাংলাদেশকেও গতিশীল হতে হবে। নতুন প্রযুক্তিতে এবং একই সাথে কর্মশক্তির দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করার সময় এসেছে। বাংলাদেশও একদিন বিশ্ব অর্থনীতি এবং সামাজিক প্রবৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দিতে পারবে। 

 

Feature Photo: iStock 
Source: 

01. Fourth_Industrial_Revolution_in_Bangladesh_Prospects_and_Challenges. 
02. The-fourth-industrial-revolution-what-it-means-and-how-to-respond. 
03. Fourth-industrial-revolution. 
04. Preparing-Bangladesh-the-fourth-industrial. 
05. 4th-industrial-revolution-and-the-job-market-of-Bangladesh. 
06. Facing-4ir-challenges-looks-daunting-technical-education-still-backseat.