প্রায় ২,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি প্ল্যানেটরি নীহারিকা যা সাউদার্ন রিং নীহারিকা নামে পরিচিত। এটি এতদিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে গোপন ছিল। এটি মূলত গ্যাসের একটি প্রসারিত মেঘ যা মৃত নক্ষত্রকে ঘিরে থাকে। প্রথমবারের মতো একটি দ্বিতীয় মৃত নক্ষত্রও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে একটি প্ল্যানেটরি নীহারিকার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ধাপগুলো এখন খুঁজে পাওয়া যাবে।
আর এই অসাধারণ বিষয়টি সম্ভব হয়েছে নাসার বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী মহাকাশ বিজ্ঞান টেলিস্কোপ, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে। এটি একটি ইনফ্রারেড বা অবলোহিত অবজারভেটরি যা পৃথিবী থেকে প্রায় ১ মিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থান করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
এটি মহাবিশ্বে গঠিত প্রথম গ্যালাক্সিগুলো খুঁজে এবং প্ল্যানেটরি সিস্টেম গঠনকারী নক্ষত্রগুলো দেখতে পায়। এর সমৃদ্ধ ইনফ্রারেড ১৩.৫ বিলিয়ন বছরেরও বেশি সময় পেছনে দেখতে পাবে। এই টেলিস্কোপটি ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১-এ, ফরাসি গায়ানার ইউরোপের স্পেসপোর্ট থেকে আরিয়েন-৫ (Ariane 5) রকেটে ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম সকাল ৭.২০-এ উৎক্ষেপণ করা হয়।
নামকরণ
ওয়েব পূর্বে ‘নেক্সট জেনারেশন স্পেস টেলিস্কোপ’ (এনজিএসটি) নামে পরিচিত ছিল। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে নাসার ২য় প্রশাসক জেমস ই. ওয়েবের (১৯০৬ – ১৯৯২) নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। তিনি অ্যাপোলোর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA) এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (CSA) মিলে ওয়েবের প্রজেক্টে কাজ করেছে। নাসা গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার উন্নয়ন প্রচেষ্টা পরিচালনা করছে। প্রধান শিল্প সহযোগী নর্থরপ গ্রুমম্যান এবং স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট লঞ্চের পরে ওয়েব পরিচালনা করছে।
ডিজাইন
নিয়ার-ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ (NIRSpec) ০.৬-৫.৩ মাইক্রন ডোমেনে চারটি ভিন্ন স্পেকট্রোস্কোপিক মোড প্রদান করে। মাল্টি-অবজেক্ট স্পেকট্রোস্কোপি (MOS) মোডে, ৯ বর্গ-আর্ক-মিনিটের দৃশ্যের ক্ষেত্রে ১০০টিরও বেশি উৎসের বর্ণালি একসাথে পাওয়া যেতে পারে।
ওয়েবের নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা (NIRCam)-এর গভীরতর ইনফ্রারেড ভিশন ০.৬ মাইক্রন থেকে ২৮.৫ মাইক্রন পর্যন্ত। এর ৭টি ব্রডব্যান্ড ফিল্টার, ১২টি মাঝারি ব্যান্ড ফিল্টার, বেশ কয়েকটি ন্যারো ব্যান্ড ফিল্টার এবং দীর্ঘ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ছিদ্রহীন গ্রিজম (Grism) রয়েছে।
এটিতে দুর্বল লেন্স এবং অন্যান্য হার্ডওয়্যার রয়েছে যা টেলিস্কোপের ওয়েভফ্রন্ট সেন্সিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হবে। এটি করোনাগ্রাফিক (coronagraphic) ক্ষমতা ধারণ করে।
আয়না
ওয়েবের বৃহত্তর প্রাইমারি মিরর হাবলের প্রাথমিক আয়নার ছয়গুণ আলো সংগ্রহ করার ক্ষমতা রাখে। যা আমাদের হাবলের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি ক্ষীণ বস্তুর চিত্র প্রদান করবে। হাবলের আয়নার ওজন প্রায় এক টন। একই উপাদান দিয়ে তৈরি একটি ওয়েব-আকারের প্রাথমিক আয়না কক্ষপথে উৎক্ষেপণের পক্ষে খুব ভারি হবে।
এই সমস্যাটি সমাধান করার জন্য, ওয়েবের আয়নাটি বেরিলিয়াম দিয়ে তৈরি যা শক্তিশালী এবং হালকা এবং ১৮টি ষড়ভুজ অংশ নিয়ে গঠিত এবং স্বর্ণ দিয়ে আবৃত। স্বর্ণ ইনফ্রারেড আলোকে আরও দক্ষতার সাথে প্রতিফলিত করে যা ওয়েবকে ইনফ্রারেড তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল করে তোলে।
ষড়ভুজ মিরর সেগমেন্টের প্রতিটির সাথে এবং এর সেকেন্ডারি মিররের সাথে একটি ছোট যান্ত্রিক মোটর অ্যাসেম্বলির একটি সিরিজ রয়েছে, যাকে অ্যাকুয়েটর বলা হয়। এগুলো একে অপরের সাথে সঠিক প্রান্তিককরণে এনে প্রতিটিকে ৩-মাত্রিক স্থানে নিয়ে যায়।
সানশিল্ড
সানশিল্ডে ক্যাপ্টন নামক উপাদানের পাঁচটি স্তর থাকে। সানশিল্ডের প্রতিটি স্তর নিচের স্তরের চেয়ে শীতল। স্তরগুলোর মধ্যে থেকে তাপ বিকিরণ করে এবং স্তরগুলোর মাঝের ফাঁকা জায়গা একটি ভাল অন্তরক হিসাবে কাজ করে। ক্যাপ্টন বিশেষভাবে প্রলেপযুক্ত বিশেষ তাপীয় বৈশিষ্ট্যের একটি হালকা ওজনের উপাদান।
প্রতিটি স্তরে অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপ এবং সূর্যের দিকে মুখ করে থাকা দুটি উষ্ণতম স্তরের (নির্ধারিত স্তর ১ এবং স্তর ২) মাঝে একটি ‘ডোপড-সিলিকন’ আবরণ রয়েছে যাতে সূর্যের তাপকে মহাকাশে প্রতিফলিত করা যায়। এর প্রতিটি স্তর অবিশ্বাস্যভাবে পাতলা।
স্তরগুলো সামান্য ভিন্ন গঠন এবং বিভিন্ন আকারের। স্তর ৫ সবচেয়ে ছোট এবং স্তর ১ বৃহত্তম। স্তর ১ তুলনামূলকভাবে সমতল এবং স্তর ৫ আরও বাঁকা। স্তরগুলো কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে তাপ প্রত্যক্ষ করার জন্য কেন্দ্রে কাছাকাছি এবং প্রান্তে আরও দূরে থাকে।
বিশেষ সেলাই
ঝিল্লির উপাদানটি শক্ত, তবে এতে একটি ছোট ছিদ্র হলে সেটি আরও বড় হতে পারে। তাই থার্মাল স্পট বন্ড (TSB) নামে একটি বিশেষ প্রক্রিয়া এখানে ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি স্তর একসাথে গলে যায়। এছাড়াও, মেমব্রেন উপাদানের শক্তিশালী রেখাগুলোর তাপীয় স্পট, প্রতি ৬ ফুট পর পর প্রধান মেমব্রেনের সাথে যুক্ত হয়ে একটি গ্রিড প্যাটার্ন তৈরি করে। সুতরাং, যদি একটি ছোট উল্কা থেকে সানশিল্ডের একটি স্তরে ছিদ্র হয়েও যায়, ক্ষতির পরিমাণ হবে সীমিত।
কক্ষপথ
এত দূরের বস্তু থেকে অবশিষ্ট তাপগ্রহণ করার অর্থ হলো ওয়েবকে অত্যন্ত ঠান্ডা (-৩৭৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা -২২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) হতে হবে। এর জন্য এটি হাবলের চেয়েও পৃথিবী থেকে অনেক দূরে হতে হবে। ওয়েব পৃথিবীর সাথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে প্রায় এক মিলিয়ন মাইল দূরে দ্বিতীয় Lagrange বা L2 পয়েন্টের চারপাশে।
চূড়ান্ত সিস্টেম পরীক্ষা
একটি বড় স্পেস টেলিস্কোপের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পরীক্ষা চূড়ান্ত সিস্টেম পরীক্ষা। ওয়েব সার্ভিসিংয়ের জন্য ডিজাইন করা হয়নি, তাই তার এই পরীক্ষা প্রয়োজনীয় ছিল। ওয়েবের প্রতিটি ধাপ আলাদা করে টেস্ট করা হয়েছিল চূড়ান্ত সিস্টেম পরীক্ষার জন্য অনিশ্চয়তা কমানোর জন্য।
এই চূড়ান্ত পরীক্ষাটি আশ্বস্ত করেছে যে ওয়েব অন-অরবিটে যুক্ত হতে পারে। এটি পরীক্ষার খরচকে যৌক্তিক করে তোলে। সেই সাথে, যেকোনো সমস্যা সনাক্ত করার জন্য অপ্রয়োজনী ধাপ দূর করে এবং নির্ভুলতা বজায় রাখে।
SMACS 0723
ওয়েব দূরবর্তী মহাবিশ্বের সবচেয়ে গভীরতম এবং তীক্ষ্ণতম ইনফ্রারেড চিত্র দেখায়। ওয়েবের ফার্স্ট ডিপ ফিল্ড নামে পরিচিত ছবিটি গ্যালাক্সি গুচ্ছ বা ক্লাস্টার SMACS 0723। এটি হাজার হাজার গ্যালাক্সির একটি গুচ্ছ যার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষীণ বস্তুগুলোও রয়েছে৷ এটি এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা সবচেয়ে দূরবর্তী ছায়াপথগুলোর মধ্যে একটি।
WASP-96b (স্পেকট্রাম)
ওয়েব আমাদের সোলার সিস্টেমের বাইরে একটি এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডলে প্রথম পানি সনাক্তকরণ করেছে। এটি এখন অন্যান্য গ্রহের বায়ুমণ্ডলগুলো কী দিয়ে তৈরি তা বোঝার চেষ্টা করবে।
Stephan’s Quintet
ওয়েব, পেগাসাস নক্ষত্রমন্ডলে অবস্থিত এই ছায়াপথের একটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে ঘিরে থাকা ধূলিকণার আবরণ ভেদ করে; তার সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের কাছে গ্যাসের বেগ এবং গঠন প্রকাশ করে।
জীবনকাল
ওয়েবকে ১০ বছরের লক্ষ্যসহ কমপক্ষে পাঁচ বছরের একটি মিশনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। স্পেসের কঠোর পরিবেশে ওয়েবের হার্ডওয়্যার সময়ের সাথে সাথে ক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা মিশনের জীবনকালকে সীমিত করতে পারে। যদিও মহাকাশযান প্রায়ই তাদের পরিকল্পিত মিশনের জীবনকাল অতিক্রম করে কাজ চালিয়ে যায়। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে সীমিত পরিমাণ জ্বালানী রয়েছে। একবার জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে এটি আর ফিরে আসবে না।
বিষয়টি দুঃখজনক এবং একইসাথে মনে হতে পারে অনেক বড় ধরনের অপচয়। কিন্তু, বৈজ্ঞানিক অনেক গবেষণা এবং অভিযানই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। ওয়েব মহাকাশ গবেষণায় নতুন যুগের সূচনা করেছে। একইসাথে বিলিয়ন বছর আগের জ্ঞানও হয়তো বিজ্ঞানীরা জানতে পারবে। অদূর ভবিষ্যতই বলে দিবে, ওয়েব আমাদের কত দূর নিয়ে যাবে আর মানব সভ্যতার উন্নয়ন সাধন করবে।
Featured Image: NASA GSFC/CIL/Adriana Manrique Gutierrez References: 01. Nasa.gov/missions/James-Webb-Space-Telescope. 02. Nasa.gov/Content. 03. Nasa.gov/Content/ForScientists/FAQScientists. 04. Nasa.gov/Content/Observatory/Sunshield. 05. Bgr.com.