স্কিজোফ্রেনিয়া: বাস্তবতা আর কল্পনায় দোদুল্যমান থাকে যে রোগী

166
0

আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল
নাটোরের বনলতা সেন

জীবনানন্দ দাশের কালজয়ী এই একটি মাত্র বাক্য জানান দেয় মানব জীবনে সুখ আর অসুখের ফারাক ঠিক কতটুকু! ঈশ্বর প্রদত্ত অমূল্য এই সুস্থতার মর্ম বুঝতেই হয়তো তিনি সৃষ্টি করেছেন সামান্য জ্বর-সর্দির মতন শারীরিক অসুখ থেকে শুরু করে মনে বাসা বাঁধার মতন ভয়ংকর কিছু রোগ।

তেমনই একটি মনের রোগ স্কিজোফ্রেনিয়া। ‘ফাইট ক্লাব’, ‘বিউটিফুল মাইন্ড’, ‘হাইড এন্ড সিক’ মুভিগুলো যারা দেখেছেন তারা ‘স্কিজোফ্রেনিয়া’ নামক মানসিক এই রোগটা সম্পর্কে কম-বেশি পরিচিত। আর যারা পরিচিত নন তাদের কাছে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিটি ভূতে ধরা কোনো ব্যক্তির তুলনায় আলাদা কিছু নয়!

অবাস্তব কিছু দেখা, অথবা শোনা, কল্পনায় কোনো একটা চরিত্র সৃষ্টি করে তার সাথে বসবাস, অসংলগ্ন কথা বলার মতন বিক্ষিপ্ত আচরণ প্রকাশ পায় এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণে। অতি সাধারণ লোক থেকে শুরু করে শিল্পী, লেখক, বিজ্ঞানী বা গবেষক অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

মনোজগৎ বিক্ষিপ্ত থাকে স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর।  Image Source: themindsjournal.com

গবেষণায় দেখা গেছে, সৃজনশীল ব্যক্তিদের শতকরা ৮০% বেশি আশঙ্কা থাকে স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার। একারণেই হয়তো তাদের অনেক লেখনি অথবা তুলির আঁচড়ে উঠে এসেছে স্কিজোফ্রেনিকদের ছায়ামূর্তি। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য, বিখ্যাত ব্যান্ড ‘পিংক ফ্লয়েড’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা সীড ব্যারেট, অভিনেত্রী ভেরোনিকা লেক, গণিতবিদ জন নাস জুনিয়ার।

স্কিজোফ্রেনিয়া কি?  

সাধারণত ডিল্যুশন (মিথ্যা বিশ্বাস, চিন্তা অথবা অহেতুক সন্দেহপ্রবনতা), হ্যালুসিনেশন (অবাস্তব, অস্তিত্বহীন কোনো জিনিস দেখা বা শোনা), অস্বাভাবিক শারীরিক আচরণ, অগোছালো চিন্তাভাবনা এবং অসংলগ্ন কথাবার্তা এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে দেখা যায়। ব্যক্তির নিজের চিন্তা এবং অনুভূতির প্রকাশে কোনো সঙ্গতি থাকে না। রোগী নিজে ব্যতীত আশেপাশের অন্য কেউ এসকল শব্দ বা অবয়ব শোনে বা দেখে না।

নিজের মস্তিষ্ক এবং আশেপাশে একটি কাল্পনিক পরিবেশ সৃষ্টি করে বলেই তাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো থাকে ভ্রমগ্রস্ত এবং অবাস্তব। উদাহরণস্বরূপ, তারা বিশ্বাস করতে পারে যে কেউ তাদের মন নিয়ন্ত্রণ করছে বা তাদের ক্ষতি করতে যাচ্ছে। এই ধরনের মনোব্যাধি পর্বগুলি রোগীর নিজের এবং তার পরিবারের জন্য ভীতিকর এবং বিভ্রান্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। 

অদ্ভুত সব কল্পনা আর অনূভুতির সাথে বাস। Image Source: media.tumblr.com

স্কিজোফ্রেনিয়া একজন ব্যক্তির জীবনকে ভীষণভাবে এলোমেলো করে দিতে পারে। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তিটি একটি শিশুও হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কদের কর্মক্ষেত্রের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে নেওয়া, সমাজের সকলের সাথে স্বাভাবিক সামাজিকতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে। 

একজন স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য দৈনন্দিন কাজগুলি সম্পূর্ণ করা বা নিজের যত্ন নেওয়ার মতন সাধারণ কাজগুলো একটি স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় তাদের পক্ষে কঠিন। তবে সঠিক এবং উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে, যেমন—সাইকোথেরাপি বা মানসিক চিকিৎসা এবং সামাজিক সহায়তার সংমিশ্রণ—স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা রোগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে, পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারেন।

স্কিজোফ্রেনিয়ার পেছনের ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলো 

যদিও গবেষকদের কাছে এখনও স্পষ্ট না স্কিজোফ্রেনিয়ার পেছনের কারণগুলো। তবে ধারণা করা হয়, বংশগত কারণে কেউ এই রোগের বাহক হতে পারে৷ অর্থাৎ, বাবা কিংবা মা অথবা উভয়ের রোগটি থাকলে সন্তানের স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৮০% বেড়ে যায়। এছাড়াও, গর্ভকালীন নানান ধরনের জটিলতাও এই রোগের কারণ হতে পারে বলে অনেক চিকিৎসক মনে করেন।

স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির জেনেটিক বিন্যাস। Image Source :bmj.com

এছাড়াও, শৈশবে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা, প্রচন্ড মানসিক চাপ, ক্ষোভ, দুঃশ্চিন্তা অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থাও মানসিক এই রোগটার কারণ হতে পারে। শুধু তাই নয়, অনেক সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষও আস্তে আস্তে এই রোগের দিকে ধাবিত হতে পারে। যার মূল কারণ হিসেবে দৈনন্দিন জীবনের অশান্তি, অতৃপ্তি, উত্তরাধুনিক যুগের মনস্তাত্ত্বিক দোটানা, বিক্ষিপ্ত চিন্তা এবং কল্পনা প্রবণতাকে অনেক চিকিৎসক চিহ্নিত করেছেন।  

স্কিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ  

অন্যান্য সকল মানসিক রোগের লক্ষণের সাথে তুলনার বিচারে এই রোগের লক্ষণ বেশ আলাদা। শুধুমাত্র অবসাদ কিংবা নির্লিপ্ততা নয় স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মাঝে দেখা যায় কাল্পনিক জগতে বসবাস অথবা অলীক কিছু দেখা। অবাস্তব কিছু দেখা, শোনা, কেউ তাদের সাথে বাস করে অথবা কথা বলে এমন অনেক কিছুই লক্ষ্য করা যায় তাদের মাঝে। যা একদম অবিশ্বাস্য এবং অবাস্তব।

ফলে অন্য সকল স্বাভাবিক মানুষের সাথে সমাজে একসাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটায়। একপর্যায়ে তারা অন্যদের সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তাও বন্ধ করে দেয়। যার দরুন আরো বেশি একা, নিঃসঙ্গ এক জীবনে প্রবেশ করে স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি। এমনকি আত্মঘাতীও হয়ে উঠতে পারেন। 

স্কিজোফ্রেনিকদের কিছু মুখাবয়ব।  Image Source: psychnews.psychiatryonline.org

রোগীদের কেউ কেউ শুধুমাত্র দেখা বা শোনা না, অনেকে এমন অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে যে, কোনো মানুষ অথবা জন্তু তাদের ক্ষতি করতে চাইছে। তাদের উপর হামলা করছে। যা বাস্তব নয় শুধুমাত্র তাদের ভ্রম। এই ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ যেকোনো ব্যক্তির পক্ষে অত্যন্ত কষ্টদায়ক এবং অসহনীয়।

স্কিজোফ্রেনিয়া রোগের চিকিৎসা  

শুধুমাত্র স্কিজোফ্রেনিয়া নয়, যেকোনো মানসিক সমস্যা বা রোগের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে কাজটি করণীয় সেটি হলো রোগীর পরিবারসহ আশেপাশের সকলের বোধগম্য হওয়া, স্কিজোফ্রেনিয়া একটা স্বভাবিক অসুখ। শারীরিক যেকোনো সমস্যার যেমন চিকিৎসা হয় বা হওয়ার প্রয়োজন আমরা বোধ করি, এজন্য যেমন চিকিৎসালয় রয়েছে, নির্দিষ্ট কিছু মেডিসিন রয়েছে। তদ্রুপ, মানসিক যেকোনো সমস্যারও চিকিৎসা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। এবং জরুরিও বটে। 

এটি গবেষণায় প্রমাণিত, যেকোনো মানসিক অসুস্থতার প্রভাব মানুষের মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলে। যার প্রভাবে দিন দিন রোগীর সুস্থ হওয়ার হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। মানসিক যেকোনো রোগ মস্তিষ্কে কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে তা কেবল একজন সুস্থ এবং অসুস্থ ব্যক্তির মস্তিষ্কের গঠন এবং রাসায়নিক উপাদানের পার্থক্য দেখলেই বুঝতে পারা যায়।

মস্তিষ্কের পরিবর্তন। Image Source: https://i.guim.co.uk

এই রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসকের প্রথমে কিছু অ্যান্টি-সাইকোটিক বা মনোরোগ বিরোধী ঔষধ দিয়ে থাকেন। এরপর ধীরে ধীরে প্রয়োজন অনুযায়ী সাইকোথেরাপি বা কাউন্সিলিং করে থাকেন। শতকরা ৮০% রোগী কিছুটা উন্নত জীবনযাপন শুরু করেন। তবে ১৫% থেকে ২০% রোগী সম্পূর্ণভাবে সুস্থতা লাভ করতে সক্ষম হয় না।

দিন দিন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা একদিকে যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে সচেতনতার হার সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। জনসচেতনতার জন্য প্রতিবছর ২৪ মে পালিত হয় ‘বিশ্ব স্কিজোফ্রেনিয়া দিবস’। অনেকেই মনে করেন যেকোনো মানসিক ব্যাধি কেবল মনের বিক্ষিপ্ত অবস্থা অথবা ক্ষনিকের অবসাদ। আবার অনেকের ধারণা সময়ের সাথে সাথে ঠিকও হয়ে যাবে এই ধরনের সমস্যা। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা আর সচেতনতার অভাবে অপূরনীয় শারীরিক ক্ষতি শুধু নয়, আমাদের প্রিয়জনের জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

 

 

 

Featured Image: research.uga.edu
References:

01. Schizophrenia.
02. Schizophrenia Risk Factors.