সাগরের অতলে বন্দী রাজকন্যাদের গল্প, সাগর তলের রাজার গল্প, এমনকি সাগরের তলে জলাসুরের গল্প শুনেই বড় হয়েছে অনেকেই। কিন্তু সাগরের তলে রেস্টুরেন্ট এর কথা কি আজ অবধি কেউ শুনেছে? অথবা এমন ভাবনা কি এসেছে মনে? রূপকথার কোন গল্প না, এমনকি কোন কল্পকাহিনীও না, নরওয়ের উত্তর সাগরের মাত্র সাড়ে ৫ ফুট পানির নিচে কয়েক বছর আগে চালু হয়েছে আন্ডার নামে এক রেস্টুরেন্ট।
সাগরের নীচে নাকি আছে অপার বিস্ময়, সেরকম এক বিস্ময় এই আন্ডার রেস্তোরাঁ। আর তাই বোধহয় কেউ কেউ বলে আন্ডার আবার কেউ বলে ওয়ান্ডার। প্রায় ১১০ ফুট লম্বা এই রেস্টুরেন্ট-এর অর্ধেক অংশ পানির নিচে ডুবে আছে। প্রতিদিন শ’খানেক মানুষ মাছেদের সাথে খাবার-দাবার খেতে এখানে ঘুরতে আসে, সাথে দেখতে আসে কাছেই থাকা অতি প্রাচীন লাইট হাউজ। কংক্রিকেটের তৈরি এই রেস্টুরেন্ট নিয়েই আজকের গল্প।
আন্ডার: স্থাপত্যের অদ্ভুত নিদর্শন
নরওয়ের সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই। প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন মানুষ বাস করে এই দেশটিতে। নরওয়ের আয়তন ৩,৮৫,২০৭ বর্গকিলোমিটার। দেশটির উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে ব্যারেন্টস সাগর, নরওয়েজিয়ান সাগর, উত্তর সাগর অবস্থিত। আর এই উত্তর সাগরেই অবস্থিত আন্ডার নামের এই রেস্তোরাঁ।
বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় স্থাপত্য ফার্ম স্ন্যোহেটা নির্মান করেছে ইউরোপের প্রথম এবং বিশ্বের সবচাইতে বড় আন্ডার ওয়াটার রেস্টুরেন্ট আন্ডার। সাড়ে ৫ ফুটের কংক্রিটের স্লাব, আলো আধারী আর সবুজ রঙ-এর আলোয় মোড়া এই রেস্টুরেন্ট। হঠাৎ দেখায় মনে হবে, সাগর থেকে ভেসে আসা কোন বস্তু অথবা সাগরে অর্ধনিমগ্ন কোন কংক্রিটের বিশালাকার টুকরো।
৩৪ মিটার লম্বা এই বিল্ডিং পানির নিচে ডুবে আছে প্রায় ৫ মিটার। প্রথমে সোজা করে রাখা হলেও বাতাস, সমুদ্রের ঢেউ এবং আরো কিছু প্রতিকূলতার সাথে টিকে থাকার জন্য বর্তমানে ইষৎ বাঁকা করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের জুলাইতে নির্মান কাজ শুরু হবার কয়েকমাস পরেই এটি উন্মুক্ত করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। সমুদ্রে যেহেতু ডুবে থাকবে, তাই নির্মাণের সময় নির্মাতাগণ অনেক কিছু মাথায় রেখেই কাজ করেছেন।
যেমন প্রবল সমুদ্র স্রোত আছড়ে পড়লে, এই স্লাবের অবস্থা কী হতে পারে, কিংবা সমুদ্রের এত নীচে শ্বাস নেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কী? কোন বড় সামুদ্রিক প্রাণীর ধাক্কা দিলে কি হতে পারে? এসবই।
অর্ধ নিমগ্ন এই রেস্টুরেন্টের বিশালাকার জানালা দিয়ে সমুদ্র তলদেশের ভিউ দারুনভাবে উপভোগ করা যায়। ১১ মিটার চওড়া ও ৩ মিটারের মতো লম্বা জানালা রয়েছে রেস্তোরাঁটিতে। সমুদ্র তলদেশের হরেক রকম মাছ যেমন তিমি কিংবা হাঙ্গর, উদ্ভিদ, উদ্ভিদকণাসহ অন্য সকল প্রাণীদের কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে উপভোগ করতে পারবেন মজাদার আর তাজা খাবার।
৩৪ মিটার দীর্ঘ এই রেস্টুরেন্ট-এর কিছু অংশ পানির নিচে, কিছু পানির উপরে। ঠিক যেন এক উভচর প্রাণী, পানির নিচের পরিবেশের সাথে যেমন এই বিল্ডিং টিকে থাকতে পারে, আবার পানির উপরের অংশ পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে।
৪০ জন একবারে প্রবেশ করতে পারবেন, যদিও ১০০ জন-এর জন্য সু ব্যবস্থা আছে। খাবার আগে বা পরে বিশ্রামের জন্য আছে বার এবং বিশ্রাম ঘর। পুরো ডাইনিং হল প্রায় ৫০০ বর্গমিটারের মতো। সময় ভেদে, খাবার ভেদে কেউ ১০ মিনিট সময় কাটায় আবার কেউবা ৬০ মিনিট।
যতটা সময় আপনি থাকেন না কেন, আপনাকে মাছেদের সাথে সময় কাঁটাতে হবে। কিন্তু এক বিন্দু খারাপ লাগবে বলে মনে হয় না। সমুদ্রেরর সকল প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করার সক্ষমতা নিয়ে তৈরি এই আন্ডার, যেখানে এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা দেখা যায়নি। যা প্রমাণ করে এর নির্মানশৈলী নেহাত মন্দ নয়।
মেন্যু
গ্যাটে উবস্তাদ, আন্ডার রেস্টুরেন্টের মালিক জানিয়েছেন তারা কেবল হরেক রকম মাছ দেখিয়েই ক্ষান্ত হবে না, আপনার পাতে তুলে দেবে স্থানীয় তাজা মাছের তৈরি নানান রকম খাবার, বুনো ভেড়া, পাখির মাংসসহ নানান পদের খাবার। আর এর জন্য গুনতে হবে ৪০/৫০ মার্কিন ডলার। অর্থটা কেবল একজনের জন্য। মজার ব্যপার হলো, এত বেশি বিল হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ সময়ই প্রি-বুকড হয়ে থাকে এই পানির নিচের বিষ্ময়কর রেস্টুরেন্ট।
প্রায় ১৮ থেকে ২০ রকমের খাবার, ওয়াইন কিংবা তাজা ফলের জুসসহ বিশুদ্ধ আর টাটকা খাবারের লোভে, মাছের সাথে ডিনারের জন্য প্রতিদিন ৪০ জন এই রেস্টুরেন্টে আসে। উত্তর সাগরের সাড়ে ৫ মিটার পানির নিচের এই রেস্টুরেন্ট জলের নীচের অন্যান্য রেস্তোরাঁর মধ্যে তৃতীয় এবং ইউরোপের প্রথম।
জানা অজানা কিছু কথা
মজার ব্যাপার হলো, আন্ডার-এ থাকার জায়গার ব্যবস্থা না থাকলেও কাছাকাছি অসাধারণ একটি হোটেল আছে। এই হোটেল যেন আন্ডারের জন্যই নির্মাণ করা। সাদাটে কাঠের এই হোটেল সারা বছর নরওয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত।
এর কাছেই মাত্র ১৬ মিনিটের দূরত্বে থাকা এই লাইট হাউজ ১৬৫৬ সাল থেকে পথ দেখিয়ে আসছে। যদিও বর্তমান লাইট হাউজটি নির্মিত হয় ১৯১৫ সালে। রেস্টুরেন্টে অধিক গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে, আন্ডার টিম তিমি ও হাঙ্গর মাছসহ অন্যান্য মাছকেও ট্রেইনিং দেয়া হচ্ছে।
আশেপাশের প্ল্যাংক্টনকে আকৃষ্ট করতে এক বিশেষ ধরনের আলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শুধু আলোয় না, কংক্রিটের দেয়াল এমনভাবে তৈরী করা যেন শ্যাওলা, প্ল্যাংক্টনসহ নানা উদ্ভিদ, এই স্থাপনার দিকে আকৃষ্ট হয়। অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিক রাখতে স্ন্যোহেটা টিম নিয়েছে এক বিশেষ ব্যবস্থা। অতিরিক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার বহন করার প্রয়োজন পড়বে না।
আকাশ কিংবা পাতাল, সবখানেই এখন মানুষেরা তাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় রাখছে। নরওয়েতে অবস্থিত এই রেস্টুরেন্টটি সেরকম এক স্থাপনা। কেবল ডুবুরি বা ডাইভিং জানা মানুষেরাই কেন সাগর তলের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করবে? সাধারণ মানুষ, সাঁতার না জেনে, পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার না ফেলেই সমুদ্রের অনেক দৃশ্য অবলোকন করতে পারে।
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী—
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে।
বিপুলা পৃথিবীর, এই সিন্ধুর উপর নির্মিত কীর্তি টিকে থাক সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করেই, কাঁচের দেয়ালের এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে দেখা হোক সৃষ্টির।
Feature Image: under.no References: 01. Under. 02. under the world's largest underwater restaurant. 03. worlds-largest-underwater-restaurant. 04. পানির তলদেশে সুস্বাদু খাবারের রেস্তোরাঁ। 05. under europe's first underwater restaurant.