কাসিদা: বিলুপ্ত প্রায় এক ঐতিহ্য

379
0

স্মৃতি রোমন্থন সবসময়ই আবেগপ্রবণ করে তোলে। বিশেষ করে ফেলে আসা সময়ের স্মৃতিগুলো বারবার মনে করিয়ে দেয় অতীতের যত উৎসব আনন্দ আর ঐতিহ্যের কথা। ‘কাসিদা’ ঠিক সেই রকম হারিয়ে যেতে বসা একটি ঐতিহ্য।

‘কাসিদা’ মূলত ফার্সি ভাষা হতে আগত শব্দ। যার অর্থ পরিপূর্ণ, নিরেট, ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা। কাব্যিকভাবে প্রিয়জনের স্তুতি করা। তবে শব্দটির উৎপত্তিমূল আরবি শব্দ ‘ক্বাসাদ’ থেকে। যার অর্থ পরিপূর্ণ। এর ব্যুৎপত্তিগত তথা বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় সাহিত্যিক ইবনে কুতাইবা-র নবম শতকে রচিত গ্রন্থ ‘আন শিরা ওয়া আন শুয়ারা’ (Book of poetry & poets)-তে।

কাসিদার জন্ম ইতিহাস বহু পুরোনো। দশম শতাব্দীতে পারস্যের কবিদের দ্বারা জন্ম হয় ‘কাসিদা’-র। কবি রুদাকিকেই প্রথম কাসিদা লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। গজনীর সুলতান মাহমুদের দরবারের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন ফারোখি। কবি আনভিরও কম প্রতাপশালী নন। কবি নাসির খসরুও তার নিজস্বতার গুণে আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন। খোদা তত্ত্ব, দর্শন তত্ত্ব এবং নৈতিকতার মেলবন্ধন ঘটেছিল তার রচিত কাসিদায়।

প্রচলিত ধারণা অনুসারে কাসিদার প্রথম ধরন ‘বাহারিয়া’ বা বসন্তের কবিতা এবং অন্য ধরণটি হচ্ছে ‘খাজানিয়াহ’ বা শরতের কবিতা। কাসিদা শুরু হতো প্রকৃতির বর্ণনা দিয়ে। প্রকৃতি, মৌসুম, স্মৃতিকারতা স্থান পেত মাঝখানের অংশে। শেষ অংশে থাকতো কবিতা লেখার উদ্দেশ্যের কথা।

কবি রুদাকির ভাষ্কর্য। Image Source: alchetron.com

কাসিদা মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত। নসিব, তাখাল্লাস এবং ফাখর/ হিজা/ হিকাম। ‘নসিব’ অংশে স্মৃতি-কাতরতা প্রকাশ পায়। ‘তাখাল্লাস’-এও স্মৃতি-কাতরতা থাকবে, সেই সাথে গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা-প্রকৃতির বিবরণ, অতঃপর আবেগ-আচ্ছন্নতাকে কেন্দ্র করে দেয়া হয় অভিযাত্রার বর্ণনা, যাকে ‘রাহিল’ নামে অভিহিত করা হয়।

শেষ অংশ তিনভাবে হতে পারে। ফাখর/ হিজা/ হিকাম।
‘ফাখর’ তথা নিজ গোষ্ঠীর গুণকীর্তন।
‘হিজা’ তথা অন্য গোষ্ঠী নিয়ে প্রহসন।
‘হিকাম’ তথা নৈতিক বাণী।

কাসিদা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। স্তুতি, দর্শন, রমজান, ঈদসহ নানা বিষয়ভিত্তিক কাসিদা। এদেশে ‘কাসিদা’ সংস্কৃতির প্রচলন ঘটে ১৬০৮ সালের দিকে। মুঘল সুবাদারের এই বাংলা মুলুকে প্রবেশের মধ্য দিয়ে। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে রমজান মাসে এর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। যদিও সময়ের বিবর্তনে আজ এই ঐতিহ্য প্রায় বিলীন।

‘বাহারস্থান-ই-গায়েবি’ গ্রন্থে ঢাকার কাসিদার উল্লেখ পাওয়া যায়। এর লেখক ছিলেন ঢাকা নগরের প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম খান চিশতীর সেনাপতি। নবাব খাজা আহসান উল্লাহর সময়ে কাসিদার চর্চা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি নিজেও কাসিদা রচনা করতেন। তার উর্দু কাব্যগ্রন্থ ‘কুল্লিয়াতে শাহীন’-এর প্রমাণ।

সেহরির সময় মানুষকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সেহরি খেতে আহ্বান করার চল হয় সওয়াব তথা পূণ্য লাভের উদ্দেশ্যে। কালের বিবর্তনে তা হয়ে যায় ঐতিহ্যের অংশ। শুরুর দিকে কাসিদার প্রচলন উর্দু এবং ফার্সিতে হলেও পরে একটি বর্তমান পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মুখে প্রচলিত হিন্দী ও উর্দুতে চর্চা শুরু হয়। ইট-পাথরের এই যান্ত্রিক শহরে আজ যেখানে অ্যালার্ম শুনে ঘুম ভাঙে একসময় সেখানকার বাসিন্দারা নির্ভর করতো এই কাসিদার জন্য।

কাসিদাকে মামুলি করে দেখার কোনো সুযোগ কোনোভাবেই নেই। এই নিয়ে রমজান মাসে মহল্লায় মহল্লায় নিয়মিত প্রতিযোগিতা হতো। এই প্রতিযোগিতায় বিচারক রাখা হতো চারজন। সঠিক উচ্চারণ, ছন্দবদ্ধ চরণ, সুর-তাল-লয় এবং যথাযথ আনুষ্ঠানিকতার ভিত্তিতে বিজয়ী দল নির্বাচিত হতো।

পুরান ঢাকার কাসিদা। Image Source: bangla.bdnews24.com

কাসিদার দলগুলো এলাকা ভিত্তিক লোকজনকে ডেকে তোলার কাজে নিয়োজিত থাকতো। সুর করে বিভিন্ন শায়েরি পরিবেশন, প্রচলিত গানের সুরের অনুকরণে নিজেদের মতো নতুন একটি গান সৃষ্টি এসব করেই তারা কাসিদার আবেদনকে বহুকাল ধরে রাখতে পেরেছিল। কাসিদার গায়ক, সুরকার, রচয়িতা সকলকেই খুব সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়। প্রধান গায়ককে বলা হয় ‘সালারে কাফেলা’।

রমজানের কাসিদা আবার সবসময় একই রকম হয় না। পবিত্র এই মাস যেমন রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত-এ তিনভাগে বিভক্ত তেমনি কাসিদাও তিনভাগে বিভক্ত। এগুলো হলো চানরাতি আমাদ, খোশ আমদেদ ও আলবিদা। পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার পর এই মাসের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে ‘চানরাতি আমাদ’ পরিবেশন করা হয়। রমজানের মধ্যভাগ পর্যন্ত পরিবেশিত হয় ‘খোশ আমদেদ’। ২৭ রমজান পর্যন্ত গাওয়া হয় ‘আলবিদা’। ‘আলবিদা’ পর্বে হযরত আলী (রা)-এর খঞ্জরবিদ্ধ হওয়া ও মারা যাওয়ার ঘটনা শোকগাথা হিসেবে পরিবেশিত হয়।

ঈদ উপলক্ষে পরিবেশিত হয় ঈদের কাসিদা। মূল গায়ককে বলা হয় ‘লোকমাদার’। বাকিরা তার সঙ্গে কোরাস ধরে। বিশেষ কাসিদাগুলো রচিত হয় জনপ্রিয় গানের অনুকরণে। মোটামুটি এই পাঁচ ধরনের কাসিদার হদিস মেলে।

এই চর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল পুরান ঢাকার উর্দু রোড। এছাড়াও হোসনী দালান, বকশীবাজার এলাকায়ও এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। তখনকার রমজানের নিত্যকার চিত্র ছিল, ১০-১৫ জনের একটি দল মহল্লায় ঘুরে ঘুরে সেহরীর আহ্বান জানাচ্ছে। এ দলে উঠতি বয়সের কিশোর-তরুণদের অংশগ্রহণই থাকত বেশি। কাসিদাগুলো এরকম-

আল্লাহ কা বান্দেকো
হাম আয়ে জাগানেকো
হার দিল মে রামজান কি পায়গাম পওচায়েঙ্গে
হো জায়েগি ইয়ে দুনিয়া রামজান মুবারাকি
আল্লাহ কা রাহমাত কি
হাম তুফান উঠায়েঙ্গে…..

এটি একটি উদাহরণ মাত্র। এরকম বহু কাসিদা পুরো রমজান মাস জুড়ে পরিবেশিত হত। আবার কিছু লোক টিনের চোঙা হাতে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরত।

উঠো রোজাদারো সেহরিকা ওয়াক্ত হো গিয়া
উঠো রোজাদারো চার বাজ গায়া।
কিংবা,
উঠো রোজাদারও
সেহারিকা ওয়াক্ত খাতাম হো নে চালা।

দৈনন্দিন জীবনের অভ্যস্ততায় এগুলো ধীরে ধীরে মিশে গিয়েছে শিকড়ে। পুরান ঢাকা ঐতিহ্য সন্ধান করতে তৎপর বহু লেখক। তারাই কাসিদার সকল আদ্যোপান্ত তাদের গবেষণা, বইয়ে তুলে ধরেছেন। সেই সাথে হারিয়ে যেতে বসা এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে নানা পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।

নগরায়নের এই যুগে বিষয়টি কঠিনই বৈকি। তবুও থেমে নেই প্রচেষ্টা। নানা জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে টুকরো টুকরো প্রামাণ্য দলিল ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সংরক্ষিত হচ্ছে। মানুষ এসব পুরোনো ঐতিহ্য নিয়ে নতুন করে ভাবছে। থেমে নেই প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টাও।

‘কাসিদা অব ঢাকা’। Image Source: www.imdb.com

এসবের অংশ হিসেবে কাসিদা নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রামাণ্যচিত্রও। ২০২০ সালে অনার্য মুর্শিদের তৈরি ‘কাসিদা অব ঢাকা’ দিল্লির ‘ইন্দুস ভ্যালি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ পুরষ্কার লাভ করে। নিঃসন্দেহে এদেশের জন্য এটি বিশাল একটি অর্জন।

সেই সাথে বিশ্বের দরবারে পুরোনো এই ঐতিহ্য সমূহকে পরিচিত করানোর নতুন এক দুয়ার খুলে গেছে। নতুন প্রজন্ম নিজের মেধা দিয়ে নতুন করে তৈরি করছে এদের গ্রহণযোগ্যতা। ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি উদ্ধুদ্ধ করছে সাধারণ মানুষকে।

কাসিদা শুধুই একটি ঐতিহ্য নয়। বরং এটি এদেশের যাপিত জীবনের একটি অংশ। যা জৌলুশ হারালেও অস্তিত্ব হারায়নি। কাসিদার আবেদন চিরন্তন। অ্যালার্মের শব্দ মস্তিষ্কে প্রবেশ করলেও মরমে পৌঁছায় না। কাসিদা গেঁথে থাকে মনে আর মরমে। শিকড়ের টান অনুভব করে হৃদয়।

 

 

Feature Image: Prothom Alo
Sources- 

01. Qasida. 
02. ফিরে এল কাসিদা। 
03. qaṣīdah.  
04. রোজাদার জাগরণে ঐতিহ্যবাহী কাসিদা