ঝলমলে ফ্যাশন দুনিয়ার শুরুর গল্প

239
0

বন্ধুমহলে একজন থাকে না যে বলেমুককে লাল না বরং কালো শাড়ি পরলে মানাবে, তমুকের গোল কাটিংয়ের কামিজ পরা উচিৎ না, পুরনো ছাঁচের গয়না পরলে গর্জিয়াস লাগবে, পাঞ্জাবি কেনার সময় বোতামটা খেয়াল রাখতে হবে, কিংবা যার কাছে খবর থাকে, মার্কেটে এখন ফুলেল নকশা কাপড়ের চাহিদা চলছে না ঝকমকে কাপড়ের

এমন একজনের হাত ধরেই কিন্তু শুরু হয়েছিল ফ্যাশন ডিজাইনিং এর যাত্রা। একটা সময় নাম না জানা সাধারণ দর্জিরা পোশাক তৈরি করতেন। ১৮ শতকের মধ্যভাগের আগে ফ্যাশন ডিজাইনিং ব্যাপারটা ঠিক গড়ে উঠেনি। এরইমধ্যে ১৮৫৮ সালের দিকে চার্লস ফেড্ররিক ওর্থ প্যারিসে মেইজন করটুয়ারেই (Maison Couturier) স্থাপন করলেন; যার বাংলা অর্থ ফ্যাশন হাউজ। যা পরবর্তীতে হাউজ অব ওর্থ (House of Worth) নামে পরিচিত পায়। 

তার তৈরি করা পোশাকে নিজের নাম সেলাই করে লেবেল হিসেবে বসিয়ে দিতে লাগলেন। সাথে গণহারে পোশাক বানানোর পরিবর্তে তিনি তার ক্রেতাদের বুঝাতে শুরু করলেন যে কাকে কি পরলে ভালো লাগবে, কার জন্যে কেমন ডিজাইন বা নকশা মানাবে ইত্যাদি। ফ্যাশনের এই ধরনটিকে বলা হয় অউত করটুয়ারেই (Haute Couture)। 

চার্লস ফ্রেডরিক ওর্থ। Image Source: brittanica.com

এর আগ পর্যন্ত কেউ অউত করটুয়ারেই এবং রেডিমেড গার্মেন্টসের মধ্যে পার্থক্য সেভাবে বুঝতো না। তাই, বলা চলে ১৮ শতক থেকেই ফ্যাশন ডিজাইন জগতের যাত্রা শুরু হয়। এর আগে যা ছিল তাকে মূলত কস্টিউম ডিজাইন বলেই উল্লেখ করা যেতে পারে। আর তাই চার্লস ফেড্ররিক ওয়ার্থকে বলা হয় ফ্যাশন ডিজাইনের জনক।  

ফ্যাশন ডিজাইনকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। 

অউত করটুয়ারেই (Haute Couture)

অউত করটুয়ারেই (Haute Couture) এর ক্ষেত্রে প্রতিটি পোশাক নির্দিষ্ট একজন ক্রেতার জন্যই তৈরি করা হয়। উন্নত দামী কাপড়ের ব্যবহার, প্রত্যেকটা খুঁটিনাটির দিকে খেয়াল রেখে সেলাই করা, প্রয়োজনে কিছু হাতের কাজ করা এর প্রধান দিক। পোশাকের সৌন্দর্য এবং মাপঝোকের উৎকর্ষতা এক্ষেত্রে ম্যাটেরিয়ালের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পায়। ফলস্বরুপ, প্রতিটি পোশাক হয়ে উঠে মূল্যবান; যা ফ্যাশন হাউজের জন্য বড় অংকের মুনাফা নিশ্চিত করে। 

১৮৯৮ সালে হাউজ অব ওর্থ থেকে তৈরি করা বলগাউন। Image Souce: Metropolitan Museum of Art

ম্যাস মার্কেট (Mass Market) 

ম্যাস মার্কেট (Mass Market) এর হিসাবটা সহজ কোন ডিজাইনের চাহিদা চলছে তা বুঝার জন্য একটু সময় নেয়া, তারপর অপেক্ষাকৃত কম দামী কাপড় আর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র পছন্দ করে সেই ডিজাইন তৈরি করা, সাথে অনেক পরিমানে তৈরি করার মাধ্যমে খরচ কমিয়ে আনা।

ম্যাস মার্কেট ধারণার এটাই হলো মূলনীতি। এক্ষেত্রে যতদূর সম্ভব মেশিনের ব্যবহারের মাধ্যমেই কাজ করা হয়, যাতে খরচ হাতের নাগালে থাকে। অনেক বেশি পরিমাণে বিক্রি করা হয় বলে এই ধরণের পোশাক বা অনুষঙ্গের মূল্য কম হলেও তা লাভজনক। 

ম্যাস মার্কেটের স্বনামধন্য সব ফ্যাশন ব্র্যান্ডসমূহ। Image Source: thefashionretailer.com

রেডিমেড বা রেডি-টু-ওয়ার (Ready-to-Wear) 

উপরের দুটো ধারাকে একসাথে নিয়ে একটা দারুণ মিশ্রণ বানালেই হয়ে যায় রেডি টু ওয়্যার (Ready-to-Wear)। নির্দিষ্ট ক্রেতার জন্য বানানো হয় না ঠিকই কিন্তু অনেক বেশি যত্নের সাথে এই ক্যাটাগরির পোশাক বা অন্য আইটেমগুলো তৈরি করা হয়। এবং তা করা হয় নির্দিষ্ট পরিমাণে। ফলে বিশেষত্ব যেমন থাকে, তেমন দামটাও হয় চড়া।

তবে ওই যে মার্কেট সবার জন্যই উন্মুক্ত সাধারণত বছরে দুইবার দুইটি সিজন ধরে বিভিন্ন ফ্যাশন উইকের মাধ্যমে ফ্যাশন ডিজাইনাররা এই পোশাকগুলো মার্কেটে নিয়ে আসেন মুনাফার দিক থেকে এই ধরনটি যেমন আকর্ষণীয়, মার্কেটে নিজেদের নিজস্ব স্টাইল পরিচিত করার ক্ষেত্রেও যথাযথ। 

রেডি টু ওয়ারের সংগ্রহশালা। Image Source: pinterest.com

ঘটনাবহুল এগিয়ে চলা

শুরুর দিকে একদম প্রোডাক্ট কেন্দ্রিক থাকলেও, ধীরে ধীরে ফ্যাশন মার্কেটে যোগ হলো আরো নানা উপাদান। যেমন, বিশ শতকের শুরুতে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের দারুণ চল এলো। রোটোগ্রাভুর প্রযুক্তি (Rotogravure Technology-ইমেজ ক্যারিয়ারে ছবি খোদাই করে প্রিন্ট করার বিশেষ পদ্ধতি) এর মাধ্যমে ম্যাগাজিন ও নিউজপেপারে ছবি ছাপানো হতো তখন। 

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই ছবির কল্যাণে মানুষের কাছে ম্যাগাজিনের আকর্ষণ বাড়তে লাগলো আর বিশ্বজুড়ে ব্যাপক হারে বিক্রি হতে শুরু করলো। এর মধ্যে জনপ্রিয় কিছু নাম ছিলো জর্জস লেপেপ, আরটি, পল ইরিব, জর্জ বারবির ইত্যাদি। তবে ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘লা গেজেটে ডু বন টন’ ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে! 

মজার ব্যাপার হলো ১৯২০- ৪০ এ দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের থমথমে সময়ে সিনেমা ইউরোপ- আমেরিকা জুড়ে ভীষণ জনপ্রিয় হলো আর সেই সুযোগে সিনেমার মাধ্যমে ফ্যাশনও ছড়িয়ে গেল রীতিমতো আগুনের গতিতে। ইতিহাসের পাতায় প্যারিস ফ্যাশনের এই সময়টাকে বলা হয় ‘ফ্রেঞ্চ ফ্যাশনের সোনালী অধ্যায়’

লা গ্যাজেটে ডু মন টন ম্যাগাজিনের কিছু চিত্র। Image Source: etsy.com

কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রচুর কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফ্যাশন ইন্ড্রাস্টি কয়েক বছরের জন্য প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও ১৯৬০ সালের মধ্যেই হাওয়া বদল হতে শুরু করে। সময়ের সাথে প্যারিস হয়ে উঠে ফ্যাশনের রাজধানী। বিশ শতকের মাঝে ফ্যাশন এতটাই মানুষের জীবনের সাথে মিশে যায় আর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এমনভাবে পশ্চিমা স্টাইলকে গ্রহণ করতে শুরু করে যে ফ্যাশন ইন্ড্রাস্ট্রি এই সুযোগে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় আর দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।

যেমন চলছে সেই যাত্রা

এরপর গত দুই যুগ ধরে, ফ্যাশন ইন্ড্রাস্ট্রি যে শুধু এগিয়ে গেছে তাই নয়, নানান নতুন স্টাইল আর উদ্ভাবন দেখা গেছে জামা, জুতা, অলংকার, ব্যাগ, মেকআপ, রেগুলার বা ফর্মাল পোশাক, বিয়ের পোশাক-সবখানে। জমকালো টিভি ফ্যাশন শো, লাইভ ফ্যাশন শো আর সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় ভরা জমানায় ডিজাইনার, মডেল আর এই জগতের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্যরা কাজ যারা করেন তারা ব্যস্ততা আর নতুনত্বে ভরা এক জমজমাট সময় কাটাচ্ছেন। 

আর ফ্যাশন শো মানে কিন্তু এখন আর শুধু কাপড় কিংবা অনুষজ্ঞ দর্শকের সামনে তুলে ধরা না। কখনো পরিবেশ রক্ষার থিম, কখনো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল, কখনো আবার বিভিন্ন শিল্পীর কাজে অনুপ্রানিত হয়ে করা কাজ, সব নিয়েই এখন ফ্যাশন শো এর আয়োজন হয়। 

ট্রেন্ডি ফ্যাশনের উদাহরণ। Image Source: pinterest.com

আর এই কারণেই কাজের ভিন্নতাকে পুঁজি করে নিকোলা রিসগেয়া, মার্ক জ্যাকব, মিউচা প্রাডা, ফ্রিদা জান্নি, ফেবে ফেলো, কার্ল লেজারফেল্ড, লুই মামেঙ্গগো, মাইকেল সিনকো এর মতো ডিজাইনারদের নাম সবার মুখে মুখে। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম গ্ল্যামারাস এই ইন্ড্রাস্ট্রির উজ্জ্বলতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে আর ফ্যাশনের পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজের সাথে জড়িয়ে এই লাইনের হর্তাকর্তারা প্রমাণ করে চলেছেন যে শুধু ব্যবসা বা লাইফস্টাইলই না, তাদের হাত ধরে গড়ে উঠছে এক দ্বায়িত্বশীল পূর্ণাঙ্গ ইন্ড্রাস্ট্রি। 

 

 

 

Feature Image: Evening Standard 
References: 

01. History of Fashion Design. 
02. Fashion Designing the then and now. 
03. History of Fashion Design.