রূপকথার রহস্যময় নেকড়ে মানব যখন বাস্তবতা

820
0

খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীর কথা, মৌর্য্য সাম্রাজ্যের যুগ। এই যুগের সবচেয়ে সুন্দর ও সুনামে ঘেরা পুন্ড্রনগরেও লুকিয়ে ছিল অজানা এক বিরাট রহস্য। তবে এই রহস্যের উন্মোচন হতে চলেছিল রাজপ্রহরীর সাত বছর বয়সী ছেলে পেহওয়ার সামনে। পেহওয়া বয়সে ছোট হলেও অসীম সাহসের অধিকারী ছিল। 

বহুদিন ধরেই সে শুনে আসছে যেদিন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে সেদিন পবিত্র করতোয়া নদীর তীরে এক অদ্ভুত নেকড়ে মানব এর দেখা মিলে। সেই জীবকে দেখার আশা নিয়েই পেহওয়া লুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু যাওয়ার সময় শরীরটা মোটা চাদর দিয়ে মুড়িয়ে নিতে ভুলে যায় পেহওয়া। 

আকাশের জ্বলজ্বলে পূর্ণিমার চাঁদের আলোর দিকনির্দেশনায় পেহওয়া যখন করতোয়া নদীর তীরে পৌঁছায়, তখন সেখানে বসে থাকা দুইজন লোক হঠাৎ ভয়ে ‘নেকড়ে মানব’ বলে চিৎকার করতে থাকে। পেহওয়া তাদের আরো কাছে যেয়ে কিছু বলার আগেই তারা পেহওয়াকে পাথর মারতে থাকে। পেহওয়াকে কেন সর্বদা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হতো সেই প্রশ্নের উত্তর সেদিন ছোট্ট ছেলেটি বুঝতে পারে। 

নেকড়ে মানব Source: Youtube

নেকড়ে মানব নিয়ে এরকম অসংখ্য দেশি, বিদেশি লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। বেশিরভাগ সময়ই লোককাহিনী মানেই বানোয়াট বলে ধরে নেয়া হয়ে থাকে, কিন্তু এই কাহিনীর পিছনে কিছু সত্যতাও লুকিয়ে থাকে।

তা না হলে প্রাচীনকালে হঠাৎ করেই একজন লেখকের মনে এরকম উদ্ভট জীবজন্তুর খেয়াল না আসাটাই স্বাভাবিক। এই যেমন নেকড়ে মানবকেই নিছক কল্পকাহিনী বলে উড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে থাকা আসল সত্যের উন্মোচন করাই আজকের মূল আলোচ্য বিষয়। 

নেকড়ে মানব ধারণার উৎপত্তি  

নেকড়ে মানবের পৌরাণিক কাহিনী দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত রয়েছে। গ্রীক মিথোলজিতে রাজা লাইকাওন এবং দেবতা জিউসের কাহিনীতেও নেকড়ে মানবের ধারণা খুঁজে পাওয়া যায়। রাজা লাইকাওন একবার দেবতা জিউসের সামনে মানুষের মাংস পরিবেশন করেন এই ভেবে যে দেবতা জিউস এটিকে প্রাণীর মাংস ভেবেই আহার করবেন।

এবং এটি যে মানুষের মাংস তা বুঝতে পারবেন না। কিন্তু ঘটনা তার বিপরীতে ঘটে।  দেবতা জিউস তার সামনে মানুষের মাংস পরিবেশনের দন্ডস্বরূপ রাজা লাইকাওনকে অভিশাপ দিয়ে নেকড়ে মানবে পরিণত করেন। 

দেবতা জিউস রাজা লাইকাওনকে অভিশাপ দিয়ে নেকড়ে মানবে পরিণত করেন Source: X.com

ব্রাদার্স গ্রিমেরও একটি সংকলন বের করা হয়েছিল শুধুমাত্র নেকড়ে মানবের গল্প নিয়ে। এরকম আরো অনেক কাহিনী প্রচলিত থাকলেও মূলত রোম, গ্রীকের নৃতাত্ত্বিক, কাব্যিক এবং দার্শনিক লেখনীগুলোতেই প্রথম নেকড়ে মানবের ধারণা খুঁজে পাওয়া যায়।  

সত্যিকারের নেকড়ে মানবের ইতিহাস

১৮৬৫ সালে স্যাবিন বারিং গোল্ডের লেখা দ্য বুক অব ওয়্যারউলভস বইটি কোনো কল্পকাহিনী নয়, বরং লাইক্যানথ্রপি (মানুষ হতে নেকড়েতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া) সম্পর্কে একটি যুক্তিবাদী, আধা-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা প্রবন্ধ ছিল। 

তবে পাঠকদের কাছে কিছুটা অস্বস্তিকর বলে মনে হয়েছিল এই বইটির প্রচ্ছদটিকে। যেখানে ঘন লোমে আবৃত একজন মহিলাকে দেখতে পাওয়া যায়। মহিলাটি একটি কাগজের টুকরো ধরে আছেন, যা খুব সম্ভবত তার জন্মনিবন্ধনপত্র। এই কাগজের মাধ্যমে যেন তিনি মানুষ হওয়ার নিশ্চয়তা প্রকাশ করছেন। মূলত এই প্রচ্ছদেই লুকিয়ে রয়েছে বাস্তবতা।  

“দ্য বুক অফ ওয়্যারউলভস” বইটির প্রচ্ছদ Source: english.elpais.com

এই মহিলাটি সত্যিকার অর্থেই এই রূপে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি হলেন অ্যান্টোনিয়েটা গনসালভাস, পেট্রাস গনসালভাসের কন্যা। পেট্রাস গনসালভাস মূলত টেনেরিফের বন্য ভদ্রলোক এবং ‘ক্যানারিয়ান ওয়্যারউলফ’ নামে পরিচিত ছিলেন। মূলত তিনি হাইপারট্রাইকোসিস রোগে ভুগছিলেন এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে নথিভুক্ত হওয়া হাইপারট্রাইকোসিস কেসের তিনিই প্রথম রোগী। পরবর্তীকালে উত্তরাধিকার সূত্রে তার মেয়ে অ্যান্টোনিয়েটাও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।   

টেনেরিফ দ্বীপে (স্পেন) জন্ম নেয়া পেট্রাস এর বয়স যখন দশ বছর তখন তাকে উপহারস্বরূপ ফ্রান্সে রাজা হেনরি তৃতীয় এর কাছে পাঠানো হয়। পেট্রাসের শারীরিক অবস্থার কারণে রাজা হেনরি তৃতীয় পুরো রাজ্যে বেশ খ্যাতি লাভ করেন। পেট্রাসকে নেকড়ে মানবের দৃষ্টিতে দেখায় সবাই রাজা হেনরি তৃতীয় সম্পর্কে একটি ধারণা সৃষ্টি করে।

আর ধারণাটি ছিল তিনি যেহেতু পশুদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছেন, সেহেতু তিনি গোটা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। এইভাবে পেট্রাসের কারণে রাজার রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।

লোম ছাড়া পেট্রাস Source: HUSHED UP HISTORY
লোম ছাড়া পেট্রাস Source: HUSHED UP HISTORY

এই ধারণার পিছনের মূল কারণ হচ্ছে তৎকালীন সময়ে হিব্রু মিথোলজির অনুসরণ। এই মিথোলজি অনুসারে রাজার নেকড়েবাঘ বশ করার অর্থ হচ্ছে, অন্ধকারকে পরাজিত করে বিজয় লাভ করা, কেননা নেকড়েবাঘ হচ্ছে শয়তানের পছন্দের রূপ এবং কাউকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে তারা বেশিরভাগ সময়ই এই পশুর রূপ ধারণ করে। 

ফ্রান্সে থাকাবস্থায় পেট্রাসের সাথে লেডি ক্যাথরিনের বিয়ে হয়। তাদের দাম্পত্য জীবন থেকেই মূলত রূপকথার ‘বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট’ এর কাহিনী অনুপ্রাণিত হয়েছিল। তাদের সাত সন্তানের মাঝে চার সন্তান জেনেটিক্যালি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্মলাভ করে। 

পেট্রাস একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে জীবনযাপন এবং অভিনয় করা সত্ত্বেও, তিনি এবং তার সন্তানেরা সমসাময়িকদের দৃষ্টিতে কোনোদিন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হননি। তার চার সন্তানকেও তার পিতার মতোই অন্যান্য অভিজাতদের কাছে এক ধরনের পোষা প্রাণী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। 

তথাকথিত, ওয়্যারউলফ সিনড্রোম বা হাইপারট্রাইকোসিস এর এই অবস্থাটিকে জেনেটিক ডার্মাটোলজিকাল ডিসঅর্ডার হিসেবে চিহ্নিত করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। 

পেট্রিস এবং তার স্ত্রী লেডি ক্যাথেরিন Source: Pinterest

ওয়্যারউলফ সিনড্রোম বা হাইপারট্রাইকোসিস 

হাইপারট্রাইকোসিস এর কারণে একজন ব্যক্তির সর্বাঙ্গে অস্বাভাবিক হারে লোম বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই রোগ বিরল হওয়া সত্ত্বেও, সব লিঙ্গের এবং বয়সের মানুষেরই হতে পারে। অস্বাভাবিকভাবে লোম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যক্তির মুখ লোমে আবৃত থাকে। হাইপারট্রাইকোসিস জন্ম হতেই অথবা বয়সের বৃদ্ধির সাথে প্রকাশ পেতে পারে।

কারণ

কনজেনিটাল হাইপারট্রাইকোসিস এর মূল কারণ হচ্ছে চুল বৃদ্ধির জন্য দায়ী জিনের পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠা। আদিমানবদের মাঝে অতিরিক্ত লোম বৃদ্ধির জন্য দায়ী জিন বিবর্তনের ধারায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু হাইপারট্রাইকোসিস এর ক্ষেত্রে, অজানা কোনো কারণে ফিটাস গর্ভে থাকাবস্থায় লোম বৃদ্ধির জন্য দায়ী জিন সক্রিয় হয়ে উঠে।  

তবে কনজেনিটাল বাদে অর্জিত হাইপারট্রাইকোসিস এর বিভিন্ন উৎস থাকতে পারে। লোমের বৃদ্ধি সর্বত্র বা এলোমেলোভাবে হওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, 

  • Porphyria cutanea tarda, এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তির ত্বক আলোর প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল হয়ে থাকে।
  • পুষ্টিহীনতা।
  • ডায়েট বা খাদ্য সংক্রান্ত ব্যাধি।
  • ক্যান্সার।
  • নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ, যেমন অ্যান্ড্রোজেনিক স্টেরয়েড, চুলের বৃদ্ধির ওষুধ মিনোক্সিডিল এবং সাইক্লোস্পোরিন (স্যান্ডিমিউন)
পেট্রিস এবং তার পরিবার Source: History Collection

হাইপারট্রাইকোসিস এর চিকিৎসা  

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে কনজেনিটাল হাইপারট্রাইকোসিস এর নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই এবং জেনেটিক রোগ হওয়ায় প্রতিরোধ করার মতোও কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে অর্জিত হাইপারট্রাইকোসিস এ আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কিছু ওষুধ যেমন মিনোক্সিডিল সেবন থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে কিছুটা কমিয়ে আনা যায়। 

হাইপারট্রাইকোসিস এ আক্রান্ত হলে ছোট কিছু কাজের মাধ্যমে ব্যক্তি কিছুটা স্বস্তি লাভ করতে পারে। যেমন, শেভিং, ওয়্যাক্সিং, হেয়ার ব্লিচিং। তবে এই পদ্ধতিগুলো কিছুটা ব্যথাদায়ক এবং চামড়াতে কিছুটা চুলকানির সৃষ্টি করতে পারে। 

বর্তমানে বিরল এই রোগের কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার না হলেও অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা এই রোগেরও প্রতিকার খুঁজে পাবে বলে আশা করা যায়। কোনো এক ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীদের অবদানে এই রোগ নির্মূল করার মাধ্যমে হয়তো নেকড়ে মানবের এই ধারণাটা বাস্তব জগত থেকে হারিয়ে কল্পনার জগতেই থেকে যাবে।  

 

 

 

 

Feature Image: pixabay.com 
References: 

01. Hypertrichosis.  
02. Hypertrichosis (Werewolf Syndrome). 
03. Werewolf syndrome–myth and reality.  
04. Trick or Treated? The Real Diseases Behind the Myths of Hallowe’en.