ভূমিকম্প বলতে বোঝায় মূলত ভূ-পৃষ্ঠের কম্পনকে। আমাদের পায়ের তলায় যে মাটি তার নীচে রয়েছে শিলাস্তর কিংবা টেকটোনিক প্লেটের স্তর। এটি ১৫টি প্রধান স্ল্যাবে বিভক্ত। যখন প্রাকৃতিক কোনো কারণে এই স্তরগুলোর মধ্যে অবস্থিত শিলা বা টেকটোনিক প্লেটগুলোর পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় কিংবা একে অপরের ওপরে উঠে আসে তখন ভূ-পৃষ্ঠের নিচে এক প্রকার তরঙ্গ শক্তির সঞ্চার হয়। এই শক্তির প্রভাবেই মূলত ভূ-পৃষ্ঠ কেঁপে উঠে। আর এই কম্পনকেই ভূমিকম্প হিসেবে আখ্যায়িত করে হয়ে থাকে।
পৃথিবীতে প্রতি বছর, প্রায় ২০,০০০ ভূমিকম্প হয় এবং ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, এসকল ভূমিকম্প প্রায় কয়েক মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছে। যদিও অনেক ভূমিকম্প এতটাই ছোট যে লক্ষ্য করা, এমনকি পরিমাপ করা যায় না। তবে অন্যগুলো এত বড় যে তাদের ভয়াবহতা মৃতের সংখ্যা ও ধ্বংসের মাত্রা দিয়ে পরিমাপ করতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে এমন পাঁচটি মারাত্মক ভূমিকম্প পাওয়া যাবে যা একাই প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছে এবং সারা বিশ্বে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে।
১. শানসি, চায়না – ১৫৫৬
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্পটি সংঘটিত হয়েছিল কিংবা রেকর্ড করা হয়েছিল ২৩ জানুয়ারি, ১৫৫৬ সালে। এটি মূলত উত্তর চীনে সংঘটিত হয়। এই ভূমিকম্পের আঘাতে আনুমানিক ৮,৩০,০০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল আট এবং এর কেন্দ্রস্থল ছিল শানসির হুয়াক্সিয়ানের সবচেয়ে কাছে। যেহেতু এটি সম্রাট জিয়াজিংয়ের আমলে সংঘটিত হয়েছিল সেহেতু এটিকে ‘জিয়াজিং মহা ভূমিকম্প’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
ভূমিকম্পটির স্থায়িত্বকাল কয়েক সেকেন্ডের হলেও এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। এর ফলে পাহাড় যেমন সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছিল, ঠিক তেমনই নদীর গতিপথ পরিবর্তনসহ ব্যাপক বন্যারও সৃষ্টি করেছিল। এই ভূমিকম্প সৃষ্টির মূলে তিনটি ক্রুটি ধার্য করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো ওয়ে ওয়ে নদী। বলা হয়, ইতিহাসে উল্লেখ ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে ২৬টি মারাত্মক ভূমিকম্পের কারণ হচ্ছে এই ওয়ে ওয়ে নদী।
যে সময়ে এই ভূমিকম্পটি সংঘটিত হয় তার বিবেচনায় এর ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি আটকানোর মতো কিংবা প্রতিহত করার মতো যথেষ্ট শক্তি কিংবা সামর্থ্য কোনোটাই ছিল না। প্রায় ১০০টি দেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। এছাড়া, দুইটি প্রদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এই ভূমিকম্পটিকে ইতিহাসের তৃতীয় মারাত্মক বিপর্যয় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
২. পোর্ট-অ্যা-প্রিন্স:
২০১০ সালে হাইতিতে সংঘটিত ভূমিকম্পটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল এবং এটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে একটি বলে একটি বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এই ভূমিকম্পটি মূলত ১২ জানুয়ারি, ২০১০ সালে হাইতির রাজধানীতে আঘাত হানে। এর মাত্রা ছিল সাত।
এর ফলে আনুমানিক ৩১৬,০০০ লোক মারা গিয়েছিল। আহত হয়েছিল ৩০০,০০০ জনেরও বেশি। এছাড়া, পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি হাইতিয়ান বাস্তুহারা হয়েছিল বলে খবর পাওয়া যায়। পোর্ট-অ্যা-প্রিন্স নামক এই ভূমিকম্পটি পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে মাত্র ছয় মাইল নিচে সংঘটিত হয়।
যেহেতু হাইতির পোর্ট-অ্যা-প্রিন্সের বেশিরভাগ বহুতল ভবন কোনোরকম নিরাপত্তা নিয়ম না মেনে গড়ে তোলা হয়েছিল সেহেতু এই ভূমিকম্পের ফলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়। যদিও ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। তবুও এই ধ্বংসের বোঝা এখনো হাইতির জনগণ বয়ে বেড়াচ্ছে। এই থেকে ধারণা করা যায়, একটি দেশের অবকাঠামো শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলার গুরুত্ব।
৩. অ্যান্তিওক, তুরস্ক – ১১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
একশো পনের খ্রিস্টপূর্বাব্দের ১৩ ডিসেম্বর, তুরস্কের অ্যান্তিওকে শেষ রাতের দিকে সাত দশমিক পাঁচ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয় যা অ্যান্তিওকের দুই তৃতীয়াংশ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এর ফলে ২,৬০,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল বলে খবর পাওয়া যায়। এছাড়াও, এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক পরিমাণে প্রাণহানির পাশাপাশি সম্পদহানিও ঘটে।
এই ভূমিকম্পের বিবরণ লেখক ক্যাসিয়াস ডিও তার রচি রোমান ইতিহাসে বর্ণনা করেন। তিনি লেখেন সেই সময় অ্যান্তিওকে বহু সৈন্য ও বেসামরিক লোকজন অবস্থান করছিল। কেননা রোমান সম্রাট ট্রাজান সেখানে শীতকাল যাপনের জন্যে অবস্থান করছিলেন। ক্যাসিয়াসের বিবরণী হতে ধারণা পাওয়া যায় যে, ভূমিকম্পের শুরুতে একটি বিকট গর্জন শোনা যায়। তারপরই মাটিতে শুরু হয় তীব্র কম্পন। এই ভূমিকম্পে বহু লোকজন ধ্বংসস্তুুপের কবলে যেমন প্রাণ হারায়, তেমনি খাদ্যের অভাবেও অনেকের প্রাণহানি ঘটে।
এছাড়া, এই ভূমিকম্পের গভীরতা এতই বেশি ছিল যে, এটি একটি সুনামির উদ্রেক ঘটিয়ে দিয়েছিল। যা লেবাননের অবকাঠামোকে ব্যাপক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। এই ভূমিকম্পের ফলে অ্যান্তিওকের দুটি শহর সম্পূর্ণ রকম ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছিল।
৪. অ্যান্তিওক, তুরস্ক – ৫২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
এই ভূমিকম্পটি সিরিয়া, বিশেষ করে তুরস্কের অ্যান্তিওক শহরে ভয়াবহ আঘাত হানে। এটি মূলত ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষের দিকে সংঘটিত হয়। এটি ছিল সাত মাত্রার একটি ভূমিকম্প। এর ফলে আনুমানিক ২,৫০,০০০ হতাহতের মতন বিপর্যয় সংঘটিত হয়। এই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট অগ্নিকান্ড ছিল এত পরিমাণ, যা ছিল মানুষের মৃত্যুর অন্যতম মূল কারণ।
কেননা বাতাসের প্রভাব এই অগ্নিকাণ্ডের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। দ্য গ্রেট চার্চ ভূমিকম্পের মাত্র সাত দিন পর এই অগ্নিকান্ডের কবলে পড়ে ধসে পড়ে। এছাড়া, এই ভূমিকম্পের ফলে বেশিরভাগ বাড়িঘর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তবে ধারণা করা হয়, যেসকল বাড়িঘর পাহাড়ের নিকট ছিল সেগুলোকে বেশি একটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি।
৫. তাংশান, চায়না – ১৯৭৬
এই ভূমিকম্পটি সংঘটিত হয় ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই ভোরবেলা। এটি ছিল সাত দশমিক আট মাত্রার একটি ভূমিকম্প যা তাংশানের কয়লা-খনির শহরটিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। সরকারি জরিপ অনুসারে এই ভূমিকম্পের ফলে হতাহতের সংখ্যা ২,৪২,৭৬৯ রেকর্ড করা হলেও অন্য অনেক দিক থেকে অনুমান করে ধারণা করা হয় ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা এর দ্বিগুণ।
এই বিপর্যয়ের ফলে শহরের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা মারা গিয়েছে বলে রিপোর্ট করা হয়েছিল। এই ভূমিকম্পের আঘাতে শহরের ৮৫ শতাংশ ভবন ধসে পড়ে। এছাড়া প্রাপ্ত রিপোর্টের তথ্যানুসারে সংঘটিত ভূমিকম্পটি ভবন ধস ছাড়াও টেলিফোন, টেলিগ্রাফ সিস্টেম, নর্দমা ব্যবস্থা, রেডিও সিস্টেম, পানি সরবরাহ ব্যবস্থাসহ আরও অনেক খাতে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে।
Feature Image : Newsweek
References: