হোপ ডায়মন্ড- অভিশপ্ত এক হীরার গল্প

554
0

ডায়মন্ডের জনপ্রিয়তা নিয়ে আমাদের কারো কোনো সন্দেহ নেই, তাইনা? যুগ যুগ ধরে হীরার জনপ্রিয়তা এবং মূল্য সমানতালে একইরকম রয়েছে। আমাদের সবারই হীরার প্রতি মারাত্মক আকর্ষণ রয়েছে। নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবাই হীরার গয়না পরতে ভালোবাসে। 

তবে আজকে আমি অন্যরকম এক হীরার গল্প বলবো। হেডলাইন দেখে নিশ্চয়ই খুব অবাক লাগছে এই ভেবে যে- হীরা কীভাবে অভিশপ্ত হয়? হোপ ডায়মন্ড নামেরই এক অভিশপ্ত হীরার গল্প জানতে পারবেন আজ। 

হোপ ডায়মন্ডের উৎপত্তি 

সপ্তদশ শতাব্দীতে, হোপ নামক হীরাটি একটি খনিতে সর্বপ্রথম খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও সঠিক অবস্থানটি অনিশ্চিত। তবে ধারণা করা হয়, ভারতের গোলকোন্ডার কোল্লুর খনি থেকেই এটি উত্তোলন করা হয়েছিল। এটি আবিষ্কারের পর এক পর্যায়ে, এটি জাঁ-ব্যাপটিস্ট ট্যাভার্নিয়ার নামে একজন ভ্রমণকারী ফরাসি বণিকের হাতে চলে যায়, যিনি এটিকে ইউরোপে আনেন।  

জাঁ-ব্যাপটিস্ট ট্যাভার্নিয়ার; Image Source: imdb.com

তিনি একজন রত্ন ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৬৬৮ সালে রাজা চতুর্দশ লুইয়ের কাছে ছোট বড় আরো ১৪ টি হীরার সাথে এটিও বিক্রি করে দেন। হীরাটি নীল দ্যুতি ছড়াতো; তাই এটি ‘ফ্রেঞ্চ ব্লু’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। 

অঘটনের সূত্রপাত 

রাজা চতুর্দশ লুইয়ের মৃত্যুর পর ডায়মন্ডটি রাজা ষোড়শ লুয়ের কাছে যায় এবং সর্বনাশের সূত্রপাত এখানেই শুরু হয়। রাজার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আছে যে, তিনি এই হীরাটি তার গোপন প্রেমিকাকে উপহার  দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহী কাজে জড়িত থাকায় এটি পুনরায় রাজপ্রাসাদে ফিরে আসে। যদিও এই অভিযোগের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।  

রাজা ষোড়শ লুই এবং রাণী আন্তোনেতঁ ছিলেন চরম দুঃশাসক এবং অত্যাচারি। ফরাসি বিপ্লবের সময় এর মাশুল গুণতে হয় তাদের। গিলেটিন দ্বারা তাদের হত্যা করা হয়। আর তাদের এই করুণ মৃত্যুর কারন হিসেবে হোপ হীরাকে দায়ী করা হয়। বিপ্লবের সময়ে রাজদরবারের অন্যান্য জিনিসের সাথে হীরাটিও চুরি হয়।  

১৯ শতকের শুরুর দিকে হীরাটি ব্রিটেনে পাওয়া যায়। ১৮১৩ সালে লন্ডনে এটি পুনরুত্থিত হয়েছিল এবং ১৮২৩ সালের মধ্যে রত্ন ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল এলিয়াসনের মালিকানাধীন ছিল। তবে এটা নিশ্চিত নয় যে, লন্ডনের নীল হীরাটি গার্ডে-মেউবল থেকে চুরি করা হোপ ডায়মন্ডই ছিল কারন লন্ডনে পাওয়া হীরাটির ভিন্ন কাট ছিল। তবুও, ধারণা করা হয় এটির প্রকৃত উৎস লুকানোর আশায় হীরাটি কেটে নতুন আকৃতি দিয়েছিল। 

ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ জর্জ ড্যানিয়েল এলিয়াসনের কাছ থেকে নীল হীরাটি কিনেছিলেন এবং পরবর্তীতে ঋণে জর্জরিত হয়ে গেলে, তার মৃত্যুর পর তা পরিশোধ করার জন্য অন্যান্য সম্পদের সাথে হীরাটিও বিক্রি করে দেয়া হয়। 

কেন নীল হীরার নাম হোপ ডায়মন্ড?

১৮১৯ সালে স্যার উইলিয়াম হেনরি ফিলিপ হোপ হীরাটি কিনে নেন। পেশায় তিনি একজন ব্যাংকার। তার নাম অনুযায়ী এই হীরার নাম দেয়া হয় হোপ ডায়মন্ড। যেহেতু তিনি কখনো বিয়ে করেননি, তাই ১৮৩৯ সালে মারা গেলে তার সম্পত্তি তার তিন ভাগ্নেকে ছেড়ে দেন। প্রায় ৪৬ ক্যারেটের হোপ হীরাটি পরবর্তীতে ভাতিজাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক হেনরি থমাস হোপের কাছে যায়। 

হেনরি ফিলিপ হোপ; Image Source: wikipedia.org

হেনরি থমাস হোপ যখন ১৮৬২ সালে মারা যান, তখন হীরাটি হোপের বিধবা স্ত্রীর কাছে থেকে যায় এবং তার নাতি, দ্বিতীয় বড় ছেলে লর্ড ফ্রান্সিস হোপ উত্তরাধিকারসূত্রে হীরাটি পায়। কিন্তু সে ছিল পাক্কা জুয়ারি এবং তার জীবন বেশ অনিয়ন্ত্রিত ছিল যার কারনে, ফ্রান্সিস হোপ ১৮৯৮ সালে আদালতের কাছ থেকে হোপ হীরা বিক্রি করার অনুমতি চেয়েছিলেন-কিন্তু তার ভাইবোনেরা এটি বিক্রির বিরোধিতা করেছিল এবং তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।

তিনি ১৮৯৯ সালে আবার আপিল করেন এবং আবার তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। ১৯০১ সালে, হাউস অফ লর্ডসের একটি আবেদনে, ফ্রান্সিস হোপকে অবশেষে হীরাটি বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। 

সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে উঠে দুর্ভাগ্যের প্রতীক 

১৯০১ সালে সাইমন ফ্র্যাঙ্কেল, একজন আমেরিকান রত্ন ব্যবসায়ী হোপ হীরাটি কিনেছিলেন এবং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসেছিলেন। পরের কয়েক বছরে হীরাটি বেশ কয়েকবার হাত পরিবর্তন হয় এবং সবশেষে পিয়েরে কারটিয়েরের হাতে আসে। 

ইভালিন ওয়ালশ ম্যাকলিন, হোপ ডায়মন্ডের শেষ মালিক; Image Source: thecourtjeweller.com

পিয়েরে কারটিয়ার ইভালিন ওয়ালশ ম্যাকলিনের একজন ক্রেতা খুঁজে পায়, যিনি ১৯১০ সালে তার স্বামীর সাথে প্যারিসে যাওয়ার সময় প্রথম হীরাটি দেখেছিলেন। যেহেতু মিসেস ম্যাকলিন পূর্বে পিয়েরে কারটিয়ারকে বলেছিলেন যে সাধারণত দুর্ভাগ্য বলে বিবেচিত বস্তুগুলি তার জন্য সৌভাগ্যে বয়ে আনে তাই তিনি ভেবেছিলেন এই হীরাটি তিনি নিবেন কিন্তু মিসেস ম্যাকলিন বর্তমান হীরাটি পছন্দ করেননি, তাই তিনি এটি কিনতে চাননি।

কয়েক মাস পরে, পিয়েরে কারটিয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং মিসেস ম্যাকলিনকে কিছুদিন হোপ হীরাটি নিজের কাছে রাখতে বলেন। হোপ হীরাটিকে একটি নতুন মাউন্টে পুনরায় সেট করা হয়এবং ম্যাকলিন পরবর্তীতে হোপ হীরাটি কিনেছিলেন।  

ঘটনা এখানে শেষ হয়ে গেলেই বোধহয় ভালো হতো। হীরাটি কেনার পর প্রথম দিকের কিছুদিন বেশ স্বাভাবিকভাবেই তার জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল। কখনও কখনও তিনি গলায় ডায়মন্ডটি নেকলেস হিসাবে পরতেন, কখনোবা সেটি শোভা পেতো তার পোষা কুকুরটির গলায়। এরপরেই হুট করেই তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। প্রথমেই মারা গেলেন তার শ্বাশুড়ি। নয় বছর বয়সী ছেলেকেও হারালেন তিনি। অন্য এক নারীর জন্য তাকে ত্যাগ করলেন তার স্বামী।  

অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে ২৫ বছর বয়সে প্রাণ হারায় তার কন্যা। পরবর্তীতে তিনি মানসিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর মতো পত্রিকাও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন ইভ্যালিন। দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে যান তিনি। ঋণে জর্জরিত হয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ইভ্যালিন।

১৮০০ শতকের দিকে হোপ ডায়মন্ডকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো ঘটে তা নিয়ে ‘হোপ কার্স’ নামে নতুন একটি কলাম খুলে ফেলে সাংবাদিকরা। হীরাটির প্রতিটি মালিকের রহস্যজনক বা দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর কাহিনী ছাপানো হতো সেখানে। তবে পরবর্তীতে বাস্তবের সাথে গাল ভরা গল্পের মিশেলে ‘হোপ ডায়মন্ড’ পরিণত হলো রূপকথায়। ‘হোপ ডায়মন্ডের অভিশাপে করুণ মৃত্যুর শিকার ১০ জন ব্যক্তি’ এমন সব সংবাদও বের হতে থাকে সংবাদপত্রে। 

হ্যারি উইনস্টন এবং স্মিথসোনিয়ানের অধিগ্রহণ 

১৯৪৯ সালে যখন হোপ হীরাটি বিক্রি হয়েছিল, নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত জুয়েলার্স হ্যারি উইনস্টন এটি কিনে নেন। অনেক অনুষ্ঠানে, উইনস্টন দাতব্যের জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য হীরাটি অফার করেছিলেন। উইনস্টন ১৯৫৮ সালে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনে হোপ হীরা দান করেছিলেন যাতে একটি নতুন প্রতিষ্ঠিত রত্ন সংগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে এবং সেই সাথে অন্যদের দান করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।  

মিসেস এডনা উইনস্টন, সেক্রেটারি লিওনার্ড কারমাইকেল এবং জর্জ সুইজারকে হোপ ডায়মন্ড উপস্থাপন করছেন; Image Source: si.edu

১০ নভেম্বর, ১৯৫৮ সালে একটি সাধারণ বাদামী বাক্সে, নিবন্ধিত চিঠির মাধ্যমে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের জাদুঘরে যায় এবং এটির আগমন উপলক্ষে বেশ ধুমধাম অনুষ্ঠান উদযাপন করেছিল যেখানে অনেক লোক সমাগম হয় এবং তারা হীরাটি দেখার সুযোগ পায়।

তবে স্মিথসোনিয়ান অথরিটি বেশ কয়েকটি চিঠি এবং সংবাদপত্রের গল্প পেয়েছিল যেখানে এই হীরা সম্পর্কে সাবধান করা হয়। লিখা হয় যে, একটি ফেডারেল প্রতিষ্ঠানের দ্বারা এইরকম একটি অখ্যাত পাথর অধিগ্রহণের অর্থ সমগ্র দেশের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। যদিও এরকম কোনো ঘটনাই পরবর্তীতে ঘটেনি। 

দ্য হোপ হীরাটি বর্তমানে জাতীয় রত্ন এবং খনিজ সংগ্রহের অংশ হিসাবে জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাসের যাদুঘরে সকলের দেখার জন্য রাখা হয়েছে। সব কিছুর জানার পর আপনার যদি হীরকখণ্ডটি নিজের চোখে একবার দেখার ইচ্ছে হয়, তবে সোজা চলে যেতে পারেন জাদুঘরটিতে। 

 

Feature Image: Wallpaperflare.com
References:

  1. History of the Hope Diamond
  2. The Curse of the Hope Diamond
  3. The Secret History Of The Hope Diamond
  4. The History of the Hope Diamond
  5. Hope Diamond Timeline
  6. The Curse of The Hope Diamond